মা শোনো তোমাকে খুব জরুরি একটা কথা বলব। ভংয়কর জরুরি।
চল বাগানে যাই।
বাগানে যেতে পারব না। এখানেই বলি। কথাটা হচ্ছে—আমি জানতে পেলাম দাদীজান নাকি আজ রাতে আমার সঙ্গে ঘুমাবে। এটা যেন না ঘটে। তুমি দেখবে।
এটা তোর জরুরি কথা?
হ্যাঁ এটা আমার জরুরি কথা। দাদীজান কাল রাতে ঘুমিয়েছেন শেফার সঙ্গে এবং তাকে নাকি বলেছেন তিনি এক রাতে শেফার সঙ্গে ঘুমাবেন, আর এক রাতে আমার সঙ্গে ঘুমাবেন। এই ভাবে চলতে থাকবে এটা শোনার পর থেকে আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে।
হাতপা ঠাণ্ডা হবার কী আছে? দাদী নাতনির সঙ্গে ঘুমবে না!
না ঘুমবে না। অবশ্যই আমার সঙ্গে না। একটা লেপের নিচে আমি আর দাদীজান। উনার হাড়ি-হাডিড পা উনি আমার গায়ে তুলে দেবেন। তার শরীর থেকে আসবে শুকনা গোবরের গন্ধ। অসহ্য। মা তুমি যেভাবেই হোক আমাকে বাঁচাও।
মনোয়ারা চিন্তিত মুখে বললেন, উনি তোর সঙ্গে ঘুমুতে চাইলে আমি না করব কীভাবে?
এইসব প্যাঁচাল বুদ্ধি তোমার খুব ভালো আছে। তুমি একটা বুদ্ধি বের কর। বিনিময়ে আমি তোমার সব কথা শুনব। তুমি যদি বল আমাকে বাবার সঙ্গে বসে গল্প করতে হবে তাতেও রাজি আছি।
মনোয়ারা বিরক্ত হয়ে বললেন, ফাজলামি ধরনের কথা বলিস না। বাবার সঙ্গে গল্প করবি না তো কার সঙ্গে গল্প করবি?
মীরা হাসতে হাসতে বলল, মা তুমি কি জানো যে বাংলাদেশে প্রথম দশজন সেরা বিরক্তিকর গল্প-কথকদের মধ্যে বাবা আছেন? হি হি হি।
সন্ধ্যা মিলিয়েছে। আজহার সাহেব তার মেয়েদের সঙ্গে গল্প করছেন। মনোয়ারা চা নিয়ে ঢুকলেন। মীরা তার মাকে চোখে-চোখে বলল, মা আমাদের বাঁচাও। মনোয়ারা হাসলেন এবং তিনিও গল্প শুনতে বসলেন। ঢাকায় থাকার সময় সবাই একসঙ্গে বসে গল্প করা প্রায় কখনোই হয় না। শেফা বসবে টিভির সামনে, এক্স ফাইল বা কিছু দেখলে। মীরা থাকবে তার ঘরে, তার দরজা থাকবে বন্ধ। বন্ধ-দরজার ফাঁকফোকর দিয়ে সিডির গানের শব্দ ভেঙে ভেঙে আসবে। তার দরজায় ধাক্কা দিলে সে বিরক্ত গলায় বলবে, পরে আসো তো মা। এখন দরজা খুলতে পারব না।
আজহার সাহেব চায়ে চুমুক দিয়ে তৃপ্ত গলায় বললেন, শীতের সন্ধ্যায় আনন্দময় ব্যাপার হচ্ছে গরম চায়ের কাপ হাতে নিয়ে রিলাক্স করা। শীত যত বেশি পড়বে রিলাক্সেশন তত বেশি হবে। বরফের দেশে কী হয় দেখ। বাইরে তুষারপাত হচ্ছে। ঘরের ভেতরে ফায়ার-প্লেসে কাঠ পুড়ছে। কাঠের গনগনে আগু। সেই আগুনের পাশে গোটা পরিবার জড়ো হয়েছে। আগুন তাপাতে তাপতে কফি খাচ্ছে!
শেফা বলল, কফি খাচ্ছে না বাবা, মদ খাচ্ছে।
আজহার সাহেব বললেন, এটা মা তুমি একটা ভুল কথা বললে। ইংরেজি ছবি দেখে-দেখে তোমার এই ধারণা হয়েছে। আসলে ওরা মদ্যপান কম করে। বরং আমি দেখি বাংলাদেশের উচ্চবিত্তদের মধ্যে এটা অনেক বেশি। অর্থবিত্তের প্রমাণ হিসেবে মদ্যপালকে ব্যবহার করা হচ্ছে। মদ্যপান হয়ে দাঁড়িয়েছে স্ট্যাটাসের অংশ।
শেফা গম্ভীর হয়ে বলল, বাবা তোমায় সাধারণ কথাও বক্তৃতার মতো কেন?
মনোয়ারা হেসে ফেললেন। সঙ্গে সঙ্গেই হাসি বন্ধ করে বললেন, এই শোনো তুমি একটা মজার গল্প আমাদের শুনাও তে।
মজার গল্প
হ্যাঁ মজার গল্প। তোমার মেয়েদের ধারণা তুমি মজার গল্প জানো না।
মজার গল্প মানে কি ঐ ঞ্জ গল্প?—আচ্ছা শোনো নেদারল্যান্ডের এবোরজিনদের একটা অলুত কাস্টমের কথা বলি। নেদারল্যান্ডের এক প্রাচীন আদিবাসী গোষ্ঠী আছে, তাদের অদ্ভুত সামাজিক কিছু নিয়মকানুন আছে। তাদের মধ্যে একদল আছে যাদের বলা হয় Sin eater. সিন ইটার মানে হল পাপ-খাদক। তারা অন্য মানুষদের পাপ খেয়ে ফেলে।
মনোয়ারা বললেন, ও মাগো। কী বলছ তুমি! পাপ যাবে কীভাবে?
মনোয়ারার এত বিস্মিত হবার কারণ নেই। তিনি এই গল্প এর আগে তিনবার শুনেছেন। তিনি বিস্মিত হচ্ছেন গল্প জমিয়ে দেবার জন্যে।
আজহার সাহেব বললেন, মনে কর কেউ মারা গেল। তখন করা হয় কি, মৃত ব্যক্তিকে নগ্ন করে মাটিতে শুইয়ে রাখা হবে। তার শরীরে নানান খাদ্যদ্রব্য সাজিয়ে রাখা হবে। তারপর খবর দেয়া হতে Sin eaterদের। Sirl eaterরা আসবে, তারা চেটে পুটে মৃতদেহের উপর থেকে খাবারদাবারলি খেয়ে ফেলবে। বিশ্বাস করা হয় যে তারা খাবারদাবারের সঙ্গে মৃতব্যক্তির সব পাপও খেয়ে ফেলবে। মৃত ব্যক্তি হয়ে যাবে পুরোপুরি নিষ্পাপ এবং সে সরাসরি স্বর্গে চলে যাবে। আর Sin eaterরা যাবে অনন্ত নরকে।
শেফা এবং মীরার ভেতর গল্প শুনে কোনো ভাবান্তর হল না, কিন্তু মনোয়ারা চোখমুখ কুঁচকে ফেললেন। ঘেন্না-মেশানো গলায় বললেন-তওবা আসতাগফিরুল্লা, বলে কী?
আজহার সাহেব উৎসাহিত হয়ে দ্বিতীয় গল্প শুরু করতে যাবেন, তখন দেলোয়ার কে খবর দিল স্থানীয় স্কুলের হেডমাস্টার সাহেব কয়েকজন শিক্ষক নিয়ে এসেছেন। আজহার সাহেব সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়লেন। স্কুলের মাস্টাররা প্রতিদিন সন্ধ্যাতেই এ-বাড়িতে আসহেন। মুগ্ধ হয়ে আজহার সাহেবের গল্প। শুনছেন। আজহার সাহেব তাদের সঙ্গে অত্যন্ত আনন্দময় কিছু সময়।
আজহার সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে খুশি-খুশি গলায় বললেন, মনোয়ারা বাইরে চা-টা পাঠাবার ব্যবস্থা কর। আর শোনো এদের একবেলা আমি খাওয়াতে চাই। পোলাও টোলাও কর। বেচারারা এই শীতের রাতে দূর দূর থেকে আসে। এত রাতে না-খেয়ে ফেরত যায়। খারাপ লাগে।