দেলোয়ার সাহেব।
জ্বি।
দেলোয়ার সাহেব।
জ্বি।
আপনি কি আমার কথায় মন খারাপ করেছেন?
জ্বি করেছি। চাচাজীকে আমি অনেক বড় চোখে দেখি।
কিন্তু আমি কি কথাগুলি ভুল বলেছি? আপনাকে বাবা যে স্নেহ করেন সেই স্নেহ কি স্বার্থজড়িত স্নেহ না?
জ্বি না। আমার একবার খুব অসুখ হয়েছিল। খারাপ ধরনের জন্ডিস। আমাকে নেত্রকোনা সদর হাসপাতালে ভর্তি করল। জীবনের আশা ছেড়েই দিলাম। তখন স্যার খবর পেয়ে গাড়ি নিয়ে নেত্রকোনা দাসপাতালে আমাকে দেখতে এলেন। আমার অবস্থা দেখে মনে খুবই কষ্ট পেলেন।
কী করে বুঝলেন মনে কষ্ট পেয়েছেন।
চাচাজীর চোখে সঙ্গে সঙ্গে পানি এসে গেল। চোখের পানি মুছে বললেন–দেলোয়ার তোর এ কী অবস্থা। চাচাজী কখনো আমাকে তুই বলেন। না। সব সময় তুমি বলেন। সেদিনই প্রথম তুই বললেন।
আপনি কী করলেন?
আমি চাচাজীরে বললাম, চাচাজী আপনি যদি আমার কপালে হাত রেখে আল্লাহপাকের কাছে একটু দোয়া করেন, আমি ভালো হয়ে যাব।
বাবা তাই করলেন?
জ্বি, তিনি কপালে হাত রেখে দোয়া করলেন। সন্ধ্যাবেলা দোয়া করলেন এশার ওয়াক্ত থেকে শরীর ভালো হতে শুরু করল। রুচি চলে গিয়েছিল, যা। খেতাম বমি করে দিতাম। রুচি ফিরে এল। রাতে নার্সকে বললাম—সিস্টার হিল ভর্তা দিয়ে একটু ভাত খেতে ইচ্ছা করছে।
কী ভর্তা?
হিদল ভর্তা। হিদল হল পুঁটিমাছের একরকম শুঁটকি, অনেকে বলে চেপা শুঁটকি।
হিদল ভর্তা দিয়ে ভাত খেলেন?
জি। ভরপেট ভাত খেলাম। পরদিন সকালে শরীর সুস্থ। সুস্থ হবে জানা কথা। পীর বংশের মানুষ। পীরাতি চাচাজীর মধ্যেও আছে। চাচাজা নিজে তা জানেন না।
আমি ওতো পীর বংশের বড় মেয়ে–আমার মধ্যে নাই?
জ্বি আপনি আপনার মধ্যে আছে।
কী করে বুঝলেন?
বোঝা যায়।
টেলিফোন-পর্ব শেষ করে ফেরার পথে মীরা খুব হাসিখুশি রইল। মজার মজার গল্প করতে লাগল। কিন্তু দেলোয়ারের মনে হল—মেয়েটার মন খুবই খারাপ হয়েছে। অতিরিক্ত হাসিখুশির ভাব যতই দেখাক না কেন মেয়েটা খুবই কষ্ট পাচ্ছে।
দেলোয়ার সাহেব।
জ্বি।
প্যান্ট এবং জুতাজোড়া আপনার পছন্দ হয়েছে তো?
জ্বি হয়েছে।
মানুষ হিসেবেও আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে। এখন যদি আপনি লুঙ্গির উপর কোট পরে ঘুরেন আপনাকে আগের মতো খারাপ লাগবে না।
দেলোয়ার হঠাৎ বলে ফেলল, আপামণি আপনার মনটা কি খারাপ?
মীরা বলল, হ্যাঁ আমার মনটা খুব খারাপ। আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা হচ্ছে। আমি কাঁদতে পারছি না।
দেলোয়ার লক্ষ্য করল মীরার চোখ পানিতে ভর্তি হয়ে গেছে। চোখের পানি টপ টপ করে পড়ছে গাড়ির স্টিয়ারিং হুইলে। দেলোয়ার সঙ্গে সঙ্গে খতমে ইউনুছ পড়া শুরু করল। এই দোয়া এক লক্ষ পচিশ হাজার বার পড়ে আল্লাহপাকের কাছে যা চাওয়া যায় তাই পাওয়া যায়। সে বতম শেষ করে আল্লাহপাককে বলবে—মেয়েটার মনটা তুমি ভালো করে দাও আল্লাহ। তুমি গাফুরুর রাহিম, তোমার রহমতের কোনো শেষ নাই। তোমার রহমতের দরিয়া থেকে একফোঁটা রহমত মেয়েটাকে তুমি দাও। এতে তোমার রহমতের দরিয়ার কোনো ক্ষতি হবে না।
মীরা বলল, দেলোয়ার সাহেব। আমি কাঁদছি আমার দুঃখে, আপনার চোখে পানি কেন?
মীরা না-ফেরা পর্যন্ত
মীরা না-ফেরা পর্যন্ত মনোয়ারা চাপা উদ্বেগ নিয়ে ছিলেন। মেয়েরা বড় হবার পর এই সমস্যা তার হয়েছে। ঘরের বাইরে যাওয়া মানেই উদ্বেগ। মনোয়ারার এই উদ্বেগ নানান ভাবে প্রকাশিত হয় তার মাথায় যন্ত্রণা হয়, কোনো কাজে মন রাখতে পারেন না। ইদানীং আরেকটি উপসর্গ যুক্ত হয়েছে শ্বাস কষ্ট। বড় বড় করে নিশ্বাস নিলেও বুক ভরে না। মনে হয় ফুসফুসের একটা বড় অংশে বাতাস পৌঁছাতে পারছে না। ফাঁকা হয়ে আছে। মনোয়ারার ধারণা মেয়ে দুটির বিয়ে হয়ে যাবার পর তার এই সমস্যা থাকবে না। তিনি আরাম করে বাকি জীবন নিশ্বাস নিতে পারবেন।
নেত্রকোনা থেকে ফেরার পর মেয়েকে দেখে তার ভালো লাগল। বেশ হাসি খুশি মেয়ে। কয়েকদিন ধরে মীরার মুখে যে অন্ধকার ভাব ছিল তা নেই। বরং খানিকটা ঝলমলে ভাব চলে এসেছে। অবশ্যি এটা অভিনয়ও হতে পারে। তার বড় মেয়ে অভিনয় ভালো জানে। ছোটটা একেবারেই জানে না।
মনোয়ারা মীরাকে বললেন, কোনো সমস্যা হয়েছিল?
মীরা হাসল। হাসতে হাসতে বলল, কোনো সমস্যা হয়নি।
মেয়েমানুষ গাড়ি চালাচ্ছে এটা দেখে লোকজন মজা পায়নি?
খুব মজা পেয়েছে।
ঢাকায় লাইন পেতে সমস্যা হয়নিতো?
উহুঁ! প্রথম রিঙেই সাবের টেলিফোন ধরল এবং আমার গলা চিনতে পারল না। বলল আপনি কে বলছেন?
তাহলে সাবের সঙ্গে কথা হয়েছে?
হয়েছে।
ও ভালো আছে তো?
ভালোই আছে তবে ওর মনে হয় ঠাণ্ডা লেগেছে। গলা কেমন যেন ভারী ভারী শুনাল। কিংবা উল্টোটাও হতে পারে। হয়তো আমার গলা শুনেই সে তার নিজের গলা ভারী করে ফেলল।
মীরা হাসছে, মনোয়ারা চলে যাচ্ছেন। মনোয়ারার মুখেও হাসি।
মীরা ভাবছে, একটা পরিবারে মায়ের ভূমিকা খুবই অদ্ভুত পরিবারের যে-কোনো সদস্য যখন হাসে, মাকে হাসতে হয়। পরিবারের যে-কোনো সদস্য যখন দুঃখিত হয়, যাকে দুঃখিত হতে হয়। এটা হল পরিবারের দাবি। পরিবার এমন অন্যায় দাবি মা ছাড়া অন্য কারো ওপর করে না।
মীরা ডাকল, মা শুনে মা ওতো।
মনোয়ারা সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এলেন। সাবেরের সঙ্গে মীরার সমস্যাটা কী? কীভাবে তা মিটমাট হল এটা জানা মনোয়ারার খুব শখ। তিনি নিজ থেকে জিজ্ঞেস করতে পারছেন না। এখন মনে হচ্ছে মীরাই বলবে।