আজহার সাহেব মেয়ের বঁড়শি ফেলা দেখতে এলেন। তার খুবই মজা লাগছে। বোঝা যাচ্ছে তার ছোট মেয়েটা গ্রাম পছন্দ করতে শুরু করেছে। তিনি মনেপ্রাণে চাচ্ছেন মেয়েটার ছিপে একটা মাছ ধরুক। ধরবে বলে মনে হয় না, প্রাচীন পুকুরের বুড়ো মাছগুলি ধুরন্ধর প্রকৃতির হয়—এরা সহজে ধরা দেয় না। তিনি খুশি-খুশি গলায় বললেন, তোর পাটিতে শুয়ে ঘুমিয়ে থাকলে তোর কি খুব অসুবিধা হবে?
শেফা বলল, অসুবিধা হবে না। শুধু নাক ডাকতে পারবে না। তোমার নাক ডাকার শব্দে মাছ পালিয়ে যেতে পারে।
নাক ডাকব না, শুধু চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকব। মাছ ধরার একটা মন্ত্র আছে মাঝে মাঝে মন্ত্র পড়ে—মাঝে মাঝে মন্ত্র পড়ে পানিতে টোকা দিতে হয়।
মন্ত্রটা কী?
আমি ভুলে গেছি। দেলোয়ার জানতে পারে। ওকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিস।
আজহার সাহেব নিজেই বালিশ নিয়ে এলেন। বালিশে মাথা রেখে মেয়ের পাশে শুয়ে পড়লেন।
তার হাতে কয়েকটা পেপারব্যাক। ছুটি কাটাবার সময় তিনি সঙ্গে বেশকিছু বই নিয়ে আসেন। ভাবেন ছুটির মধ্যে আরাম করে বই পড়া যাবে। কখনোই পড়া হয় না। আশ্চর্য ব্যাপার হল যখন ব্যস্ততা থাকে চরমে তখনই বই পড়া হয়। অবসর সময় কখনোই পড়া হয় না। বই পড়তে গেলেই হাই উঠে ঘুম পায়। এখনো তাই হচ্ছে হাই উঠছে। চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসছে। চেষ্টা করে ও খোলা রাখা যাচ্ছে না। আজহার সাহেব বইয়ের লেখার ওপর দিয়ে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছেন–লেখার অর্থ উদ্ধার করতে পারছেন না।
বইটা খুবই হালির হবার কথা, একটুও হাসি আসছে না—
There Were Four of us Gorge, and William Samuel Harris, and Myself, and montmoremcy. We were sitting in my room, smoking, and talking about how bad we were bad from a medical point of view I mean, of course…
আজহার সাহেব হাই তুলতে তুলতে ভাবছেন—বাক্যগুলি এত লম্বা কেন? বাক্যের শেষের দিকে এলে শুরুটা মনে থাকে না। লোকজন হাসবে কখন?
দেলোয়ারের বিস্ময় আকাশ স্পর্শ করেছে। গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মীরা! বাচ্চা একটা মেয়ে গাড়ি চালাচ্ছে, কোনোরকম ভুল করছে না। গাড়ি চালাতে চালাতে আবার তার দিকে তাকিয়ে কথা বলছে, প্রয়োজনমতো হর্ন দিচ্ছে কী আশ্চর্য! শুধু যে দেলোয়ার বিস্মিত হচ্ছে তা না, যে দেখছে সে-ই অভিভূত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছে। বিড়বিড় করে কী সব বলছে।
দেলোয়ার সাহেব।
জ্বি।
লোকজন কী অদ্ভুত চোখে আমাকে দেখছে—লক্ষ্য করেছেন।
জ্বি।
একটা শিম্পাঞ্জি গাড়ি চালিয়ে গেলে লোকজন যেভাবে তাকে দেখত আমাকে সেইভাবেই দেখছে। নিজেকে শিম্পাঞ্জি শিম্পাঞ্জি মনে হচ্ছে। আর আপনাকে মনে হচ্ছে শিম্পাঞ্জি ট্রেইনার। ট্রেইনার শব্দের মানে জানেন তো?
জ্বি জানি, শিক্ষক।
সরি, ট্রেইনার শব্দের মানে তো আপনি জানবেনই। আপনি যে বি. এ. পাশ এই তথ্য মনে থাকে না। বি. এ.-তে আপনার রেজাল্ট কী ছিল?
থার্ড ক্লাস।
থার্ড ক্লাসের জন্যেই বোধহয় কোথাও কোনো চাকরিটাকরি পাচ্ছেন না, তাই না?
জ্বি না। চেষ্টা করি নাই।
চেষ্টা করেননি কেন?
যা আছি তো ভালোই আছি। মাস শেষে চাচাজী এক হাজার টাকা দেন। আমি একা মানুষ। আমি চলে গেলে চাচাজীর বিষয়সম্পত্তি দেখবে কে। বিশ্বাসী মানুষ পাওয়া যায় না।
আপনি কি খুব বিশ্বাসী মানুষ?
জ্বি।
আপনি বাবার বিষয়সম্পত্তি দেখাশোনার জন্যে জীবন উৎসর্গ করেছেন?
দেলোয়ার উত্তর দিল না। এই মেয়েটা কথাবার্তা কোন্দিকে নিয়ে যাচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। মেয়েটা অসম্ভব বুদ্ধিমতী। এই ধরনের বুদ্ধিমত্রী মেয়েদের সঙ্গে কথাবার্তা সাবধানে বলতে হয়।
দেলোয়ার সাহেব।
জ্বি।
নেত্রকোনায় কি রেডিমেড প্যান্টের দোকান আছে?
জ্বি আছে।
আপনি দয়া করে নেত্রকোনায় পৌঁছেই একটা প্যান্ট কিনে নেবেন।
সঙ্গে টাকা আনি নাই।
টাকা আমি দেব। আপনি লুঙ্গিটার উপর কোট পরেছেন, আপনাকে সার্কাসের ক্লাউনের মতো লাগছে।
আপামণি লুঙ্গি বদলায়ে পায়জামা পরেছি। চাচিজী লুঙ্গি বদলাতে বললেন, এইজন্যে বদলেছি। আপনি বোধহয় লক্ষ্য করেন নাই।
পায়জামার উপর কোট আরো জঘন্য। আপনি অবশ্যই একটা রেডিমেড প্যান্ট কিনবেন এবং শুনন, একজোড়া জুতাও কিনবেন। আমি টাকা দেব।
জ্বি আচ্ছা।
আমার কথায় আশা করি কষ্ট পাচ্ছেন না?
জ্বি না।
আপনি তাহলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন—বাবার ঘরবাড়ি বিষয়সম্পত্তি দেখাশোনাই আপনার জীবনের ব্রত।
চাচাজীর জন্যে কিছু করতে পারা ভাগ্যের ব্যাপার।
কেন? বাবা বড় মানুষ বলে? সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বলে? লোক জনের কাছে বলতে পারবেন–আমি একজন বিচারপতির বিষয় দেখাশোনা করি—এই কারণে?
জ্বি না। উনি আমাকে অত্যধিক স্নেহ করেন।
অত্যধিক স্নেহ করলেও তার মধ্যে বাবার স্বার্থ আছে। আপনাকে তার দরকার। আপনি না থাকলে তার গ্রামের এই বিরাট বিষয়সম্পত্তি বারো ভুতে লুটে খেত।
দেলোয়ারের মনটা খারাপ হয়ে গেল। এই মেয়ে তার বাবাকে এমন ছোট করে দেখছে কেন? আজহার সাহেব কেমন মানুষ সেটাতো এই মেয়েটারই সবচেয়ে বেশি জানার কথা। এই মানুষটা তার গ্রামের জন্যে কী করেনি? মেয়েদের স্কুল বানিয়ে দিয়েছে, ছেলেদের স্কুল বানিয়ে দিয়েছে। নিজের খরচে রাস্তা ঠিক করে দিয়েছে। ডিপ টিউবওয়েল কিনে দিয়েছে। গ্রামের যে-কোনো মানুষ বিপদে পড়ে তার কাছে গিয়ে কখনো খালিহাতে ফেরেনি।