সম্রাট বললেন, এই সংবাদে আমি পরম করুণাময় আল্লাহপাকের দরবারে শুকুরগোজার করছি। দ্বিতীয় সুসংবাদটি বলো।
আপনি কামরান মীর্জার কাছ থেকে জাদুবিদ্যার একটি বই অনেকদিন থেকে চাচ্ছিলেন। কামরান মীর্জা বইটি নিয়ে এসেছেন। তিনি নিজে আপনার হাতে তুলে দেবেন।
সম্রাট দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, জাদুবিদ্যার অতি মূল্যবান একটি বই আমাকে শের শাহ্ দিয়েছিলেন। আফসোস সেই বইটা নাই। হারিয়ে ফেলেছি।
গুলবদন বললেন, সম্রাট শুধু বই কেন, অনেক কিছুই তো আপনি হারিয়ে ফেলেছেন।
ঠিক বলেছ। আমার প্রাণপ্ৰিয় কন্যা আকিকা বেগম নাই। তাকে নিয়ে অদ্ভুত সব দুঃস্বপ্ন দেখি। পালিয়ে যাওয়ার আগে কেন যে মেয়েটাকে নিজের হাতে হত্যা করলাম না!
গুলবদন বললেন, যা কিছু ঘটে আল্লাহপাকের নির্দেশেই ঘটে। এই ভেবে শান্তি পাওয়ার চেষ্টা করুন।
সম্রাট বললেন, এই ভেবে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা আমি সবসময় করি। তাতে লাভ হয় নি। মন শান্ত হয় না। মনের উপর কর্তৃত্ব মানুষের নেই। মন’ আল্লাহপাকের হাতে।
কথা শেষ করেই সম্রাট হঠাৎ কাঁদতে কাঁদতে তার আদরের কন্যাকে ডাকতে লাগলেন, মা আকিকা। আয় আমার কোলে আয় মা।
হতাশ এবং ক্লান্ত হুমায়ূন আগ্ৰায় ফিরে প্রবল জ্বরের মধ্যে পড়লেন। কোনো চিকিৎসাতেই জ্বরের উপশম হলো না। হুমায়ূনভগ্নি গুলবদন ভাইয়ের রোগমুক্তির জন্যে এক মাস রোজা মানত করলেন।
জ্বরের দশম দিনে সম্রাট বিছানায় উঠে বসলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, শাসনকার্য পরিচালনায় তিনি এখন সক্ষম। আগামীকাল থেকে দরবারে বসবেন।
হুমায়ূনের রোগমুক্তি উপলক্ষে আনন্দ-উৎসবের আয়োজন করা হলো। সম্রাটের ওজনের সমপরিমাণ ওজনের রৌপ্যমুদ্রা গরিবদুঃখীদের বিতরণ করা হলো।
সম্রাট দরবারে বসেছেন। তাঁর ভাইরাও উপস্থিত। হুমায়ূন তিন ভাইয়ের জন্য উপহার ঘোষণা করলেন। প্রত্যেকেই একটি করে ঘোড়া, পোশাক, এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা পেলেন। তিনজনকেই একটি করে নীলকান্তমণি দেওয়া হলো। দরবারে উপস্থিত আমীররা নীলকান্তমণির সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে মারহাবা মারহাবা ধ্বনি দিলেন। সম্রাট অত্যন্ত আবেগময় ভাষায় বললেন, আমার তিন ভাই আমার সর্বশক্তির উৎসস্বরূপ। তারা কিছু ভুল-ভ্ৰান্তি করেছে। মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করার প্রধান সমস্যা হলো, মাঝে মাঝে ভুল-ভ্ৰান্তির কাছে পরাজয় স্বীকার করা। আমি আমার প্রাণপ্রিয় ভাইদের সকল ভুল ক্ষমা করে দিলাম।
আমীররা আবারও বললেন, মারহাবা! মারহাবা! সম্রাট সিংহাসন থেকে নেমে এসে তার ভাইদের আলিঙ্গন করলেন। আবারও আনন্দ ধ্বনি-মারহাবা! মারহাবা!
এই দরবার আমজনতার জন্যে উন্মুক্ত না। হুমায়ূনের তিন ভাই ছাড়া আমীররা আছেন, সেনাপতিতা আছেন। পারস্য-সম্রাটের একজন দূত আছেন। রাজমহিষীরা আছেন চিকের আড়ালে। প্রথম দরবারে কী হয় তা তাদের দেখার ইচ্ছা। ভাইদের মিলানদৃশ্য দেখার নাটকীয়তা থেকে তারা নিজেদের বঞ্চিত করতে চাচ্ছেন না।
দরবারের বাইরে প্রধান ফটকে এক নাটক শুরু হয়েছে। নগ্নপদের এক লোক দরবারে ঢুকতে চাচ্ছে। তার গায়ে সস্তা উড়নি। গরমের মধ্যেও উড়ুনির উপর একটা নোংরা চাদর। মুখভর্তি খোচা খোচা কাঁচাপাকা দাড়ি। চোখ রক্তবর্ণ। সে বলছে তার নাম নিজাম। সে ভিসতিওয়ালা। সম্রাটের জীবনরক্ষাকারী।
প্রধান প্রহরী বলল, তুমি যথেষ্ট বিরক্ত করেছ। এই মুহুর্তে বিদায় না হলে তোমাকে কারাগারে ঢোকানো হবে।
নিজাম ভিসতি বলল, সম্রাট আমাকে দেখলেই চিনতে পারবেন। আমাকে একবার সাক্ষাতের সুযোগ দিন।
সম্রাটের সাক্ষাৎ পেতে যে যোগ্যতা লাগে তা তোমার নেই। তোমার পোশাক মলিন। পা খালি। তুমি সম্রাটের জন্য কোনো উপহার আনো নি। প্রহরীদের পরিতোষক তো অনেক পরের ব্যাপার।
নিজাম ভিসতি বলল, সম্রাট আমার কাছে ওয়াদা করেছেন আমাকে একদিনের জন্য সিংহাসনে বসাবেন। সম্রাট তার ওয়াদা রক্ষা করলেই আমি আপনাদের সবার পারিতোষিকের ব্যবস্থা করব।
প্রধান প্রহরী বলল, আমি আমার জীবনে অনেক হাস্যকর কথা শুনেছি, এমন শুনি নাই।
বিশ্বাস করুন, সম্রাট আমাকে দেখামাত্র চিনতে পারবেন। তিনি যদি চিনতে না পারেন তাহলে বাকি জীবন আমি অন্ধকূপে কাটাতে রাজি আছি।
ভিসতি নিজামের কথা সত্যি হলো। সম্রাট দেখামাত্র তাকে চিনলেন। হাসিমুখে বললেন, তুমি ভিসতি নিজাম না?
নিজাম কুর্নিশ করতে করতে বলল, জি আলামপনা। আপনার স্মৃতিশক্তি প্রশংসারও ঊর্ধ্বে।
আমি তোমাকে বলেছিলাম একদিনের জন্যে হলেও তোমাকে সিংহাসনে বসাবা। আজ অর্ধেকবোলা পার হয়ে গেছে, তারপরেও তুমি চাইলে আজই সিংহাসনে বসতে পার। তুমি কি আজই সিংহাসনে বসতে চাও?
সম্রাটের অনুগ্রহ এবং মহানুভবতা সমুদ্রের পানির চেয়েও বেশি। আমি আজই সিংহাসনে বসতে চাই।
সম্রাটের তিন ভাই স্তম্ভিত। আমীররা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছেন। কী ঘটতে যাচ্ছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। সম্রাট বললেন, এই ভিসতিওয়ালা তার মিশকের সাহায্যে আমার জীবন রক্ষা করেছে। জীবনরক্ষার পুরস্কার হিসেবে সে আধাবেলার জন্য সিংহাসনে বসবে। আমীররা তার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করবেন। একজন সম্রাটের প্রাপ্য সম্মানের পুরোটাই ভিসতি নিজাম পাবেন। ভিসতি নিজাম ইচ্ছা করলে রাজকীয় ফরমানও জারি করতে পারবেন।
দরবার কিছুক্ষণের জন্য শব্দহীন হয়ে গেল। সামান্য ভিসতিওয়ালা দিল্লীর সম্রাট? এ কেমন কথা? সবার দৃষ্টি ভিসতি নিজমের দিকে। দরবারের শান-শওকত দেখে সে খুব যে বিচলিত তা মনে হচ্ছে না। তার দৃষ্টি সম্রাটের দিকে নিবদ্ধ।