কিছু হল না। প্রেমের ক্ষেত্রে দৈব কখনোই সহায় হয় না। গল্পে, সিনেমায় হয়। জীবনটা গল্প সিনেমা নয়। জীবনের নায়িকারা, নায়কদের সঙ্গে রাস্তায় দেখা হলেও চিনতে পারে না। স্যাভলনের শিশি। কিনতে একবারই ফার্মেসীতে আসে। দ্বিতীয়বার আসে না। গল্পে উপন্যাসে নায়িকারা ঘন ঘন অসুখে পড়ে। ডাক্তার নায়ক তখন চিকিৎসা করে তাকে সারিয়ে তুলে। বাস্তবের নায়িকাদের কখনো কোন অসুখ হয় না, আর হলেও অন্য ডাক্তাররা তার চিকিৎসা করেন।
অবশ্যি মনসুরের বেলায় দৈব সহায় হল। শরৎকালের এক সন্ধ্যায় তার ডাক পড়ল নিরিবিলিতে। সোবাহান সাহেবের প্রেসার মাপতে হবে। তাঁর প্রেসার হাই হয়েছে। মাথা ঘুরছে। ব্লাড প্রেসার নামক ব্যাধিটির উপর, কৃতজ্ঞতায় মনসুরের মন ভরে গেল। বারান্দায় মিলি দাঁড়িয়েছিল। এও এক অকল্পনীয় সৌভাগ্য। বারান্দায় সে নাও থাকতে পারত। মিলির সঙ্গে দেখা না হলেও কিছু করার ছিল না। মিলির জন্যে তো আর তাকে ডাকা হয়নি। মিলি বলল, স্লামালিকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম।
আপনার জন্যে দাঁড়িয়ে আছি।
মনসুর হতভম্ব। বলে কি এই মেয়ে। এই কথাগুলো কি সত্যি সত্যি বলছে না মনসুর কল্পনা করছে? কল্পনা হওয়াই সম্ভব। নিশ্চয়ই কল্পনা। হেলসিনেশন।
আপনাকে বলেছে বোধ হয়। বাবার ব্লাড প্রেসার মাপার জন্যে আপনাকে খবর দেখা হয়েছে।
জ্বি বলেছে।
আপনার সঙ্গে একটা গোপন ষড়যন্ত্র করার জন্যে আমি দাঁড়িয়ে আছি।
জ্বি বলুন। আপনি যা বলবেন তাই হবে।
যদি দেখেন বাবার প্রেসার খুব হাই না। তবু বলবেন হাই। বাবার রেস্টের দরকার। ভয় না দেখালে তিনি রেস্ট নেবেন না। আপনি মিথ্যা করে বলতে পারবে না?
জ্বি না।
মিলির দৃষ্টি তীব্ৰ হল। মনসুর বলল, আমি মিথ্যা বলতে পারি না।
মিথ্যা বলতে পারেন না?
জ্বি না।
ও আচ্ছা, আমার জানা ছিল না। আপনাকে দেখে আর দশটা সাধারণ মানুষের মতাই মনে হয়েছিল, যারা প্রয়োজনে কিছু মিথ্যা-টিথ্যাও বলতে পারে। আপনি যে অসাধারণ তা বুঝতে পারি নি।
আপনি কি রাগ করলেন?
কথায় কথায় রাগ করা আমার স্বভাব না। আসুন, দোতলায় যেতে হবে। বাবা দোতলায়। সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় ওঠার পর মনসুর নার্ভাস ভঙ্গিতে বলল, একটা ভুল হয়ে গেছে।
কি ভুল?
প্রেসার মাপার যন্ত্র ফেলে এসেছি।
সেকি, প্রেসার মাপার জন্যেইতো আপনাকে ডাকা হয়েছে–সেই জিনিসই আপনি ফেলে এসেছেন? আপনি মানুষ হিসেবে শুধু যে অসাধারণ তাই না, মনে হচ্ছে খুব ভুলো মন।
আমি এক দৌড়ে নিয়ে আসব। যাব। আর আসব।
আপনাকে যেতে হবে না। আমি কাদেরকে পাঠাচ্ছি, ও নিয়ে আসবে।
না না। আমিই যাই। এক মিনিট।
মনসুর অতি দ্রুত সিঁড়ি টপকাচ্ছে। সেই দ্রুত সিঁড়ি ভাঙা দেখে মিলির মনে হল–একটা একসিডেন্ট হতে যাচ্ছে, হবেই হবে। না হয়েই যায় না। আর তখনি হুড়মুড় শব্দ হল। ডাক্তার সাহেব মাঝ সিড়ি থেকে বলের মত গড়িয়ে নিচে নামতে লাগলেন। শব্দ শুনে সোবাহান সাহেব এবং মিনু বেরিয়ে এলেন, ফরিদ বেরিয়ে এল, বাসার কাজের ছেলে কাদের ছুটে এল।
সোবাহান সাহেব বললেন, এ কে?
মিলি বলল, ডাক্তার সাহেব। তোমার প্রেসার মাপতে এসেছেন।
প্রেসার মাপতে এসে মাটিতে শুয়ে থাকার কারণ কি?
পা পিছলে পড়ে গেছেন বাবা।
পা পিছলে পড়েছে টেনে তুলবি না? হা করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
মিলিকে টেনে তুলতে হল না, মনসুর নিজেই উঠল। সার্টের ধূলা ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, একদম ব্যথা পাইনি। সত্যি বলছি।
তার চারপাশের লোকজন মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল। সোবাহান সাহেব কি একটা বলতে গিয়েও বললেন না। মনসুর বলল, এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি খাব। সোবাহান সাহেব বললেন, অবশ্যই খাবে। মিলি একে নিয়ে ফ্যানের নিচে বসা। কাদের এগিয়ে এসে বলল, আমারে ধইরা ধইরা হাঁটেন। ডাক্তার সাব। চিন্তার কিছু নাই, উপরে আল্লা নিচে মাটি।
নিচে মাটি এমন কোন লক্ষণ মনসুর পাচ্ছে না। তার কাছে মনে হচ্ছে সে চোরাবালির উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। পা ডেবে ডেবে যাচ্ছে। ঘরটাও মনে হচ্ছে একটু একটু দুলছে। কে যেন বলল, বাবা তুমি এখানে বস।
কে বলল কথাটা? ঐ মহিলা না? ইনি বোধ হয় মিলির মা। তাকে কি সালাম দেয়া হয়েছে? স্নামালিকুম বলা দরকার না? দেরী হয়ে গেছে বোধ হয়। দেরী হলেও বলা দরকার।
নিন পানি নিন।
মনসুর পানি নিল। নিয়েই ক্ষীণ স্বরে বলর, স্নামালিকুম। বলেই বুঝল ভুল হয়ে গেছে। কথা এমন জিনিস একবার বলা হয়ে গেলে ফিরিয়ে নেয়া যায় না। মনসুর লক্ষ্য করল তার চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে। সে নিশ্চয়ই খুব উল্টা পাল্টা কিছু বলেছে। টেনশনের সময় তার মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। মনসুর অবস্থা স্বাভাবিক করার জন্যে শব্দ করে হাসল। অবস্থা স্বাভাবিক হল না মনে হল আরো খারাপ হয়ে গেল।
ফরিদ বলল, ছোকরার মনে হয় ব্রেইন ডিফেক্ট হয়ে গেছে। কেমন করে হাসছে দেখুন না দুলাভাই। অবিকল পাগলের হাসি। সোবাহান সাহেব বললেন, একজন ডাক্তারকে খবর দেয়া দরকার।
ফরিদ বলল, ডাক্তার কিছু করতে পারবে বলেতো মনে হচ্ছে না। আমার ধারণা ব্রেইন হেমারেজ। হোয়াট এ পিটি, এ রকম ইয়াং এজ।
আনিস
স অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছে ভয়ঙ্কর একটা রাগের ভঙ্গি করতে। যা দেখে তার আট বছরের ছেলে টগর আঁৎকে উঠবে এবং মুখ কাচুমাচু করে বলবে, আর করব না বাবা। টগর যা করেছে তাকে ক্ষমা করার কোন প্রশ্নই উঠে না। সে ফায়ার ব্রিগেড খেলা খেলছিল। আগুন ছাড়া একরম খেলা হয় না, কাজেই অনেক কষ্টে সে বিছানার চাদরে আগুন ধরাল। তাকে সাহায্য করছিল তার ছোট বোন নিশা যার বয়স পাঁচ হলেও এই জাতীয় কাজ খুব ভাল পারে। খেলার দুটি অংশ, প্রথম অংশে বিছানার চাদর এবং জানালার পর্দায় আগুন লেগে যাবে, নিশা তার খেলনা টেলিফোন কানে নিয়ে বলবে, হ্যালো, আমাদের বাসায় আগুন লেগে গেছে। তখন শুরু হবে খেলার দ্বিতীয় অংশ–টগর সাজবে ফায়ার ম্যান। বাথরুম থেকে নল দিয়ে সে পানি এনে চারদিকে ছিটিয়ে আগুন নেভাবে। বেশ মজার খেলা।