সাহায্য করলেও লাভ নেই। ভিক্ষুক হইল গিয়া আফনের ভিক্ষুক।
সে যেন আর ভিক্ষুক না থাকে। সেই চেষ্টাই করা হবে। আমি ঠিক করেছি আগামী এক ঘণ্টার ভেতর যে ভিক্ষুক এই বাড়িতে আসবে তাকে দশ হাজার টাকা দেব।
বাবাজী কি বললেন?
আগামী এক ঘণ্টার মধ্যে যে ভিক্ষুক এ বাড়িতে আসবে তাকে দেয়া হবে দশ হাজার টাকা। আমি বেশ কিছু টাকা পেয়েছি। দশ হাজার টাকা এখন কোন ব্যাপারই না। এখন বাজছে দুটা পাঁচ। তিনটা পাঁচের মধ্যে যে আসবে সেই পাবে।
হতভম্ব ভাব কাটাতে এমদাদ খোন্দকারের অনেক সময় লাগল। পাগল শ্রেণীর অনেকের সঙ্গেই তার পরিচয় আছে- এই রকম পাগল সে দেখেনি।
বাবাজী একখান কথা বলি?
বলেন।
আমিও বলতে গেলে ভিক্ষুক শ্রেণীর। টাকা পয়সা নেই। ঘর বাড়িও নাই। পরান্নভোজী আমি যদি ভিক্ষুক না হই তা হইলে আর ভিক্ষুক কে?
আপনার কথা আসছে না। যারা রাস্তায় থাকে, রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় তাদের কথা হচ্ছে। ঘড়ির দিকে লক্ষ্য রাখুন। তিনটা পাঁচ বাজা মাত্রই সময় শেষ।
অন্যদিন ভিক্ষুকের যন্ত্রণায় ঘরে থাকা যায় না। আজই ব্যতিক্রম হল, ভিক্ষুক এল না। এমদাদ খোন্দকার হাসি মুখে বলল, টাইম শেষ বাবাজী।
ফরিদ বিষণ্ণমুখে বলল, তাইতো দেখছি।
রাতে ফরিদ একেবারেই ঘুমুতে পারল না। পুরো রাতটাই বিছানায় জেগে কাটাল। দুবার মাথায় পানি ঢেলে এল। ছাদে খানিকক্ষণ হেঁটে এল। কোন লাভ হল না। তার মাথায় দুপাশের শিরা দপদপ করছে, চোখ জ্বালা করছে। বুকে এক ধরনের চাপা ব্যথা অনুভব করছে। ধনী হওয়ার যে এত যন্ত্রণা তা কে জানত?
মিলিও ঘুমুতে পারল না।
সে লক্ষ্য করেছে পুতুল ফিরেছে। হাসি মুখে। তার সারা চোখ মুখে আনন্দে ঝলমল করছে। হাতে বড় একটা চকোলেটের টিন। টিন খুলে সবাইকে সে চকোলেট বিলি করছে। মিলিকে দিতে এসেছিল, মিলি কঠিন স্বরে বলেছে— আমি চকলেট খাই না।
এই কথায় সে ফিক করে হেসে ফেলেছে। সেই হাসি মিলির বুকে শেলের মত বিধেছে। এসব কি? কি হচ্ছে এসব? বোঝার উপর শাকের আঁটির মত বড়। আপার একটি চিঠিও এস উপস্থিত— সেই চিঠির ভাব ভাষা সবই যেন কেমন অদ্ভুত—
মিলি,
আমি ভুল করেছি কি-না তা জানি না। হয়ত করেছি। করলেও এ ভুল মধুর ভুল। সব মানুষই তার জীবনে অনেক ভুল করে। কিন্তু আনন্দময় ভুল প্রায় কখনোই করে না। আমি করলাম। তার জন্যে কি তোমরা আমাকে ত্যাগ করবে…
এই রকম চিঠি লেখার মানে কি? আপা এমন কি ভুল করবে যার জন্যে তাকে পরিত্যাগ করতে হবে। পৃথিবীর সবাই ভুল করতে পারে, আপা পারে না। তারপরও যদি কোন ভুল করে থাকে তাহলে কি সেই ভুল? ভুলের ব্যাপারটা সে স্পষ্ট করে বলছে না কেন?
নিরিবিলি বাড়ির সামনে
নিরিবিলি বাড়ির সামনে দুটি আইসক্রিমের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। টগর এবং নিশার জন্যে এই গাড়ি দুটি হচ্ছে ফরিদের উপহার। তারা আইসক্রীম খেতে চেয়েছে- ফরিদ দুগাড়ি আইসক্রম এনে বলেছে, খাও যত খাবে। আইসক্রিীম খাওয়া চলছে। খানিকটা মুখে দিয়েই— থু করে ফেলে দিতে আরেকটি হাতে নিচ্ছে। সারা মেঝেতে আইসক্রিমের স্তূপ। ঠাণ্ডায় দুজনেরই মুখে কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু খাওয়া বন্ধ হচ্ছে না।
পুতুল অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখল। তার কেন জানি এই দৃশ্য দেখতে বড় ভাল লাগছে। গভীর আনন্দবোধ হচ্ছে। কে জানে কি এই আনন্দের উৎস। তার নিউ মার্কেটে যাবার কথা ছিল তা না গিয়ে সে দোতলায় আনিসের ঘরে চলে গেল। আনিস মাথা নিচু করে একমনে কি যেন লিখছিল। মাথা না তুলেই বলল, ভেতরে এসো পুতুল।
পুতুল ঘরে ঢুকল। বসল খাটের এক প্রান্তে।
কেমন আছ?
ভাল।
এমদাদ সাহেব এসেছিলেন, বললেন তোমার না-কি বিয়ে।
পুতুল কিছু বলল না। আনিস বলল, খবরটার মধ্যে একটা কিন্তু আছে বলে আমার ধারণা। আমি দূর থেকে যতদূর দেখেছি আমার মনে হয়েছে ডাক্তার এবং মিলির বিয়েটাই অবশ্যম্ভাবী। মাঝখান থেকে তুমি কি করে এলে বলতো?
আমি আসি নাই।
তাই না-কি?
আনিস লেখা বন্ধ করে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। মাথা নিচু করে বসে থাকা গ্ৰাম্য বালিকাটিকে আজ কেন জানি আর গ্ৰাম্য বালিকা বলে মনে হচ্ছে না।
পুতুল।
জি।
এসো চ খেতে খেতে দুজন খানিকক্ষণ গল্পগুজব করি।
পুতুল সঙ্গে চা বানাতে বসল। আনিস চেয়ারে বসে তাকিয়ে আছে পুতুলের দিকে। সে চায়ের পানি গরম করছে। কেরোসিন কুকারের লালচে আভা এসে পড়েছে তার মুখে। সুন্দর লাগছে দেখতে। একটা মানুষকেই একেক পরিবেশে একেক রকম লাগে।
পুতুল, তুমি কি টগর এবং নিশার কাণ্ড দেখেছ? দুজন দুগাড়ি আইসক্রীম নিয়ে বসেছে।
পুতুল কিছু বলল না। মনে হল সে অন্য কিছু ভাবছে। জটিল কিছু যার সঙ্গে টগর নিশার তুচ্ছ কর্মকাণ্ডের কোন মিল নেই। মনে হচ্ছে হঠাৎ করে সে গভীর সমুদ্রে পড়েছে।
কিছু ভাবছ পুতুল?
জি।
নিজের ভাবনার কথা কাউকে বলা ঠিক না। তবে তুমি যদি আমাকে বলতে চাও তাহলে বলতে পার।
বলতে চাই। আপনাকে অনেকদিন বলার চেষ্টা করেছি। বলতে পারি নাই। আজ বলব।
হঠাৎ করে আজ কেন?
পুতুল এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে চায়ের কাপ আনিসের সামনে রাখতে রাখতে প্ৰায় অস্পষ্ট স্বরে বলল, আমি সারাজীবন আপনার সাথে থাকতে চাই। এই কথাটা আমি অনেকদিন বলার চেষ্টা করেছি। বলতে পারি নাই। আজ বললাম। বলে যদি কোন অপরাধ করে থাকি ক্ষমা করবেন।