সোবাহান সাহেব কিছু বললেন না। নতুন একটা ফাইল খুললেন। কাগজপত্রের স্তুপের সঙ্গে আরো কিছু কাগজপত্র যোগ হল। ফরিদ আতংকিত স্বরে বলল, কিছু পড়ে শোনানোর মতলব করছেন নাতো? আপনার মহৎ কোন রচনা পড়বার বা শুনবার তেমন আগ্ৰহবোধ করছি না। আশা করি এই সত্য কথাটা বলে ফেলার অপরাধ ক্ষমা করবেন।
তোমাকে কিছু পড়ে শোনাব না।
ধন্যবাদ।
তোমাকে যে জন্যে ডেকেছি তা বলার জন্যে কিছু ভূমিকা প্রয়োজন।
ভূমিকা বাদ দিয়ে মূল প্রসঙ্গে চলে এলে ভাল হয়। আমার ঘুমের সময় পার হয়ে যাচ্ছে। একটা নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমুতে না গেলে আর ঘুম আসবে না। ঘুম ব্যাপারটা মানব জীবনের একটা আনসলভডমিষ্ট্রি।
সোবাহান সাহেব ফরিদের দিকে একটা সবুজ মলাটের ফাইল এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, এটা পড়। মন দিয়ে পড়।
কিছু পড়তে পারব না দুলাভাই। মন দিয়ে পড়ারতো প্রশ্নই আসে না। কি বলতে চান সংক্ষেপে বলে ফেলুন।
ফরিদ, পরতে না চাইলেও এটা তোমার ফাইল। তোমার সঙ্গেই থাকবে। এতদিন আমি হেফাজতে রেখেছি।
এতদিন যখন রেখেছেন এখনো রাখেন। আমার পক্ষে ফাইল রাখা সম্ভব নয়। একটা ফাইলে আমার যাবতীয় পরীক্ষার সার্টিফিকেট এবং মার্কশীট রেখেছিলাম। গত চার বছর ধরে ফাইল মিসিং। আমিও গেছে ছালাও গেছে। সাটিফিকেট গেছে যাক। ফাইলটার জন্যে আফসোস হচ্ছে। সুন্দর ফাইল ছিল।
সোবাহান সাহেব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। প্ৰচণ্ড ধমক দিতে যাচ্ছিলেন নিজেকে সামলে নিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে অতি জরুরি একটা কাজ করবেন— মেজাজ ঠাণ্ডা রাখা দরকার। সোবাহান সাহেবের শ্বশুর ফরিদের বাবা বেশ কিছু টাকা রেখে গিয়েছিলেন। জামাইকে নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন টাকাটা যেন গচ্ছিত থাকে। যদি কোন দিন মনে হয় ফরিদের মাথা ঠিক হয়েছে তাহলেই টাকাটা তাকে দেয়া যাবে। সেই টাকা ব্যাংকের নিরাপদ আশ্রয়ে বেড়ে বেড়ে হুলুস্কুল ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফরিদের মাথা ঠিক হয়েছে। এ রকম কোন ধারণা সোবাহান সাহেবের হয়নি। তবু তিনি টাকাটা দিয়ে দিতে চান। সে করুক তার যা করতে মন চায়।
ফরিদ।
জ্বি দুলাভাই।
পড়।
ফরিদ নিতান্ত অনিচ্ছায় পড়ল। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে ব্যাপারটা এখনো সে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না। কোন লেখাই সে দ্বিতীয়বার পড়ে না। এই লেখাগুলো তাকে দ্বিতীয়বার পড়তে দেখা গেল।
দুলাভাই, এতো কেলেংকারিয়াস ব্যাপার।
সোবাহান সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, কেলেংকারিয়াস ব্যাপার মানে? একটা স্ল্যাং ব্যবহার করলাম। স্ল্যাংটার মানে হচ্ছে দারুণ ব্যাপার। এই টাকাটা কি সত্যি আমাকে দিয়ে দিচ্ছেন?
হুঁ।
আমি যা ইচ্ছা তা করতে পারি?
সোবাহান সাহেব কিছু বললেন না। ফরিদ চিন্তিত গলায় বলল, এত টাকা দিয়ে কি করব তাইতো বুঝতে পারছি না। আপনি বরং অর্ধেক রেখে দিননো প্রবলেম।
তুমি এখন আমার ঘরে থেকে বিদেয় হও।
বিদেয় হতে বলছেন?
হ্যাঁ।
টাকার পরিমাণ এখানে কি ঠিকঠাক লেখা? মানে দশমিকের ফোটা এদিক ওদিক হয়নিতো?
না। তুমি বহিস্কার হও।
হচ্ছি। কেলেংকারিয়াস ব্যাপার হয়ে গেল দুলাভাই। আশা করছি ব্যাপারটা স্বপ্ন হলে যখন ঘুম ভাংবে। তখন দারুণ একটা শাক পাব।
ফরিদ ঘর থেকে বের হল। প্রথমেই দেখা রহিমার মার সঙ্গে। ফরিদ হাসি মুখে বলল, কেমন আছ রহিমার মা?
জ্বি মামা ভাল। আমার কাছে তোমার যদি কিছু চাওয়ার থাকে চাইতে পার। আজ যা চাইবে—তাই পাবে। Sky is the Iimit কি চাও?
রহিমার মা বেশ কিছু সময় ভেবে বলল, পাঁচটা টাকা দেন মামা। ফরিদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। মানুষের আশা-আকাঙক্ষা কত সীমিত। যা ইচ্ছা তাই চাইতে বলা হয়েছে। সে চেয়েছে পাঁচটা টাকা। বড় কিছু চিন্তা করার মত অবস্থাও এদের নেই। সব চিন্তা ক্ষুদ্র চিন্তা। অভাব অনটন মানুষের কল্পনাশক্তিকেও সম্ভবত খর্ব করে।
এই নাও পাঁচ টাকা। তুমি যে কত বড় ভুল করলে তুমি জান না রহিমার মা। যা চাইতে তাই পাইতে— Sky is the limit.
রহিমার মা দাঁত বের করে হাসল। হাসি না থামিয়েই বলল, তাইলে মামা আরো পাঁচটা টাকা দেন।
ফরিদ আরেকটা পাঁচ টাকার নোট বের করল। রহিমার মার মুখের হাসি আরো বিস্তৃত হল।
বসার ঘরে শুকনো মুখে মিলি বসে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার উপর দিয়ে বড় ধরনের একটা ঝড় বয়ে গেছে। ফরিদ যখন বলল, তুই আমার কাছে কি চাস মিলি? যা কিছু চাইবার তাড়াতাড়ি চেয়ে ফেল— টাইম নেই।
মিলি কঠিন গলায় বলল, তুমি মামা বড় বিরক্ত কর। এখন যাও।
কিছু চাইবি না?
না।
এই সুযোগ জীবনে দ্বিতীয়বার আসবে না Once in a life time.
প্লীজ যাওতো! প্লীজ। যাচ্ছি। তুই এমন মুখ করে বসে আছিস কেন? মনে হচ্ছে তুই আলফ্রেড হিচককের কোন ছবির নায়িকা।
এমদাদ খোন্দকারকে যখন জিজ্ঞেস করা হল- আপনার যদি আমার কাছে কিছু চাইবার থাকে তাহলে চাইতে পারেন। যা প্রার্থনা করবেন তাই পাবেন।
এমদাদ খোন্দকার অনেক ভেবে চিন্তে বলল, একখান সিগারেট খাওয়ান বাবাজী, বিদেশী। দেশীটা খাইলে গলা খুসখুসি করে।
ফরিদ নিজেই দোকান থেকে এক কাঠি বেনসন এন্ড হেজেস এনে দিল। এমদাদ খোন্দকার গাঢ় স্বরে বলল, বাবাজীর ব্যবহারে প্রীত হইলাম। বড়ই প্রীত হইলাম।
এমদাদ সাহেব!
জ্বি।
আজ আমার মনটা বড়ই প্ৰফুল্ল। আজ আমি কোন ভিক্ষুককে বড় ধরনের সাহায্য করতে চাই।