এক্ষণ পাঠাইতেছি।
ডাক্তার তাহলে পুতুলকে নিয়ে বেড়াবার জন্যে বসে আছে?
এমদাদ হাসিমুখে মাথা নাড়ল।
ব্যাপারটা সত্যি নয়। ডাক্তার বসে আছে কারণ এমদাদ তাকে বলেছেএকটু বাস, তোমার সাথে সোবাহান সাহেবের জরুরি কথা আছে। ডাক্তার বসে আছে জরুরি কথা শোনার জন্যে।
এমদাদ পুতুলকে সাজিয়ে ডাক্তারের সামনে উপস্থিত করল। হাসিমুখে বলল, সোবাহান সাহেব বলছেন পুতুলকে নিয়ে চিড়িয়াখানা দেখাইয়া আনতে। এতে তোমাদের পরিচয়টা ভালো হইব। বিবাহের আগে পরিচয়ের দরকার আছে। আমাদের সময় দরকার ছিল না। কিন্তু এখন যুগ ভিন্ন। যে যুগের যে বাতাস।
মনসুর যন্ত্রের মত উঠে দাঁড়াল। এগিয়ে গেল গেটের দিকে। পুতুল তাকে অনুসরণ করল। পুতুলের মুখ হাসি হাসি। তাকে দেখাচ্ছেও চমৎকার। চাপা আনন্দে তা চোখ চিকমিক করছে। মনসুর বলল, তুমি চিড়িয়াখানায় যেতে চাও?
জি চাই।
মনসুর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। পুতুল বলল, আপনার যেতে ইচ্ছা না করলে যাওয়া লাগবে না।
মনসুর ইতস্তত করে বলল, একটা সমস্যা হয়ে গেছে পুতুল।
পুতুল বলল, আমি জানি।
হতচকিত ডাক্তার বলল, তুমি জান?
জানব না কেন? আমিতো বোকা না। আমি সবই জানি।
কি জান?
আমি জানি যে দাদাজানের কথার প্যাচে আপনি রাজি হয়েছেন। আসলে আপনি রাজি না।
কি করে বুঝলে?
পুতুল মুখ নিচু করে বলল, আপনি যে এই বাড়িতে মিলি আপারে দেখার জন্য আসেন সেটাতো সবাই জানে ৷
ও আচ্ছা।
মনসুরের বুকের উপর চেপে থাকা আধমণি পাথর সরে গেল। তার নিঃশ্বাস-প্ৰশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এল। দুই শালিক দেখা তাহলে পুরোপরি বৃথা হয়নি। বড় ভাল লাগল পুতুলকে। চমৎকার মেয়ে। মেয়েটা যে এত চমৎকার তা আগে বোঝা যায় নি।
পুতুল। চল চিড়িয়াখানায় যাই।
কেন?
কারণ তুমি খুব ভাল একটা মেয়ে। আচ্ছা পুতুল তুমি যে খুব ভাল মেয়ে তা কি তুমি জান?
পুতুল হাসতে হাসতে বলল, জানি।
পুতুলের এই কথায়ও ডাক্তার বিস্মিত হল। পুতুলকে সে লাজুক ধরনের গ্ৰাম্য বালিকা হিসেবেই ধরে নিয়েছিল। এখন দেখা যাচ্ছে সে মোটেই লাজুক নয়। কথাও বলছে চমৎকার ভঙ্গিতে।
পুতুল।
জি।
দুপুরে আজ আমরা কোন একটা হোটেল খাব। বিকেলে মহিলা সমিতিতে নাটক দেখব। তোমাকে বাসায় দিয়ে আসব। অনেক রাতে।
কেন?
তোমার দাদাজানকে আমি দুশ্চিন্তার মধ্যে ফেলে দিতে চাই। তাছাড়া তোমার সাথে আমি আলোচনাও করতে চাই।
কি আলোচনা?
এই জট থেকে কি করে উদ্ধার পাওয়া যায়। সেই বিষয়ে আলোচনা।
বলতে বলতে কি মনে করে যেন মনসুর হেসে ফেলল। সেই হাসি দেখে হাসতে লাগল পুতুল। অনেকদিন সে অকারণে এমন করে হাসেনি। তারা লক্ষ্য করল না যে তাদের অকারণ হাসাহাসি এবং রিকশায় পাশাপাশি বসার পুরো দৃশ্যটি গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখছে দুজন। গেটের ফাঁক দিয়ে এমদাদ খোন্দকার এবং দােতলার ছাদ থেকে মিলি। দৃশ্যটা দেখতে দেখতে এমদাদ খোন্দকারের মুখ চাপা হাসিতে ভরে গেল। মিলির চোখ ভরে গেল জলে। অনেক চেষ্টা করেও সে সেই জল সামলাতে পারল না।
আনিস তার লেখা নিয়ে বসেছিল। নিশা তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, মিলি খালা কাঁদছে। ছাদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। বাবা বড়দের কি কাঁদা উচিত?
আনিস বলল, না উচিত না। তবে মাঝে মাঝে বড়রাও কাঁদে। বড়দের জীবনেও দুঃখ-কষ্ট আসে।
আমি কি উনাকে জিজ্ঞেস করব কেন কাঁদছে?
না, তা ঠিক হবে না। ছোটরা কাঁদলে জিজ্ঞেস করা যায়। বড়দের যায় না।
উনাকে কাঁদতে দেখে আমারো কাঁদতে ইচ্ছা করছে বাবা।
কাঁদতে ইচ্ছা করলে কাঁদ।
শব্দ করে কাদবো না আস্তে আস্তে কাঁদবো?
আমার মনে হয় নিঃশব্দে কাঁদাই ভাল হবে।
নিশা বিছানায় চলে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।
আনিস ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। আজ অনেকদিন পর সে তার লেখার খাতা নিয়ে বসছে। লেখায় মন বসছে না। এক ঘণ্টায় মাত্র দশ লাইন লেখা হয়েছে। এই দশ লাইনে তারপর শব্দটা তিনবার। তার লেখালেখির ক্ষমতাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কি-না কে জানে। হয়ত যাচ্ছে। আনিস প্ৰাণপণে চেষ্টা করছে মন লাগাতে- অভ্যোসটা যেন পুরোপরি চলে না যায়।
নিশা চোখ মুছে বলল, কি করছ বাবা?
লিখছি।
গল্প।
হুঁ।
বড়দের না ছোটদের?
লেখার মধ্যে বড়দের ছোটদের কিছু নেই মা। লেখা সবার জন্যে।
নিশা মাথা নেড়ে বলল, বড়দের লেখায় প্ৰেম থাকে। ছোটদের লেখায় থাকে না। তুমি আসলে কিছু জান না।
আনিস এই প্রসঙ্গ পুরোপুরি এড়িয়ে যাবে ঠিক করেও মনের ভুলে জিজ্ঞেস করে ফেলল– প্ৰেম কি মা?
নিশা মিষ্টি করে হাসল। তার হাসি দেখে মনে হল প্ৰেম কি তা সে জানে তাবে এই বিষয়ে বাবাকে কিছু বলবে না। আনিস গল্প লেখা বন্ধ করে চিঠি লিখতে বসল। খুব চমৎকার করে বিলুকে এটা চিঠি লিখতে হবে। খুব দীর্ঘ চিঠি না। সংক্ষিপ্ত চিঠি— বিলু তুমি চলে এস। চলে এস, চলে এস, চলে এস।
ফরিদ দুপুরে খাওয়া শেষ করে দিবানিদ্রার আয়োজন করছে এমন সময় তার ডাক পড়ল। সোবাহান সাহেব জরুরি তলব পাঠিয়েছেন। ফরিদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। দুলাভাইয়ের এমন কোন জরুরি কথা তার সঙ্গে থাকতে পারে না। যার জন্যে দুপুরের ঘুম বাদ দিতে হবে। ট্রপিক্যাল কান্ট্রির মানুষদের জন্যে দুপুরের ঘুম যে কত দরকারী তা কাউকে বুঝানো যাচ্ছে না।
কি ব্যাপার দুলাভাই?
বস ফরিদ।
অফিস খুলে বসেছেন মনে হচ্ছে। কাগজ পত্রের ছড়াছড়ি।