স্টীমারে প্রথম শ্রেণীর যে কামরাটা রিজার্ভ করা হয়েছে তাতে দুটি বিছানা। দুর্সীটের কামরা দেখে বিলুর মুখ শুকিয়ে গেল। আনিস কি তার সঙ্গে এই কামরাতেই থাকবে? তা কি করে হয়? টিকিট আনিস করেছে। এই কাজটা কি ইচ্ছা করেই করা? ভদ্রলোক কি একবারও ভাবলেন না। একজন কুমারী মেয়ের সঙ্গে এক কামরায় সারারাত যাওয়া যায় না। বিলু। তার বাবার উপর রাগ করল। বাবার উচিত ছিল, কিভাবে যাওয়া হচ্ছে- এই সব জিজ্ঞেস করা। তিনি তাঁর কিছুই করলেন না। তাদের স্টীমারে উঠিয়ে দিয়ে অতি দ্রুত নেমে গেলেন।
এখন বিলু কি করবে?
আনিসকে ডেকে বলবে- আমরা দুজনেতো একসঙ্গে যেতে পারি না। সেটা শোভন নয়। আপনি অন্য কোথাও ব্যবস্থা করুন। এই কথাও বা কিভাবে বলা যায়?
মানুষটা তো নির্বোধ নয়।
সে এমন নির্বোধের মত কাজ কিভাবে করল? না-কি এই কাজ নিবোঁধের নয়। অনেক চিন্তা-ভাবনা করে ঠিক করা?
স্টীমার পাঁচটায় ছাড়ার কথা, ছাড়ল সাতটায়। আনিস জিনিসপত্র রুমে ঢুকিয়ে সেই যে উধাও হয়েছে আর দেখা নেই। স্টীমারেই কোথাও আছে নিশ্চয়ই। বিলুইচ্ছা করলেই তাকে খুঁজে বের করতে পারে। ইচ্ছা করছে না।
স্টীমারে বিলু কখনো ঘুমুতে পারে না। আজকের এই বিশেষ পরিস্থিতিতে তো ঘুমানোর প্রশ্নই উঠে না। বিলু তিন চারটা গল্পের বই বের করল। জানিতে একটা গল্পের বই কখনো পড়া যায় না। কিছুক্ষণ পর পর বই বদলাতে হয়এখন যে পড়েছে রেমার্কের নাইট ইন লিসবন। নাটকীয় মুহুর্তে সোয়াৎস জার্মানিতে তার স্ত্রীর ঘরে লুকিয়ে আছে। স্ত্রীর বড় ভাই নাৎসী পার্টির সদস্য। আগে সে একবার সোয়ৎিসকে কনসানট্রেশান ক্যাম্পে পাঠিয়েছিল। আবারো ধরা পড়লে মৃত্যু ছাড়া উপায় নেই। এমন সব নাটকীয় মুহুর্ত তবুও বইয়ে মন বসছে না। চাপা এক ধরনের অস্বস্তিতে মন ঢাকা।
খাওয়া দাওয়া হয়েছে?
বিলু বই থেকে মুখ তুলল। আনিস দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ হাসি হাসি। বিলু, শুকনো গলায় বলল, জ্বিনা, এখনো খাওয়া হয়নি।
রাত কিন্তু অনেক হয়েছে, খেয়ে নিন। দশটা পাঁচ বাজে।
আপনি খাবেন না?
আমি খেয়ে নিয়েছি।
কোথায় খেলেন? স্টীমারে?
জ্বি।
আমি কিন্তু সঙ্গে দুজনের মত খাবার এনেছিলাম।
কোন অসুবিধা নেই। আপনি খেয়ে নিন। খাওয়া-দাওয়ার পর দরজা বন্ধ করে শুয়ে ঘুম দিন।
যে চাপা অস্বস্তি বিলুকে চাড়া দিচ্ছিল তা কেটে গেল। ভাগ্যিস যে নিজ থেকে কিছু বলেনি।
বললে খুব লজ্জায় পড়তে হত।
আনিস বলল, এক বেডের কামরা ছিল না বলে দুই বেডের কামরা নিতে হয়েছে। অনেকগুলো টাকা খামাখা বেশি গেল। আপনি খাওয়া দাওয়া সেরে নিন। ওদেরেকে বলেছি। এগারোটার সময় আপনাকে চা দিয়ে যাবে।
চা?
আমি একদিন লক্ষ্য করেছি। রাতের খাবারের পর পর আপনি চা খান, সেই কারণেই বলা।
আপনি ঘুমুবেন কোথায়?
ট্রেন, বাস এবং স্টীমারে আমি ঘুমুতে পারি না। প্লেনের কথা জানি না। প্লেনে কখনো চড়িনি। আমি তাহলে যাচ্ছি।
বিলুকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আনিস চলে গেল। আর ঠিক তখন বিলুর মনে হল এই কামরায় গল্প করতে করতে দুজন রাতটা কাটিয়ে দিতে পারত। তাতে অসুবিধা কি হত? কিছুই না। আমরা আধুনিক হচ্ছি। কিন্তু মন থেকে সংস্কারের বাঘ তাড়াতে পারছি না। কি মূল্য আছে এইসব সংস্কারের?
বিলু চমকে উঠল, কি সব আজে বাজে কথা সে ভাবছে? তাহলে সে কি মনের কোন গভীর গোপনে আশা করেছিল আনিস থাকবে এই ঘরে? রাতটা কাটিয়ে দেবে গল্প করতে করতে? ছিঃ কি লজ্জার কথা। এমন একটা গোপন বাসনা তার কি সত্যি আছে? এই লজা সে কোথায় রাখবে? ভাগ্যিস একজন মানুষ অন্য একজন মানুষের মনের গোপন জায়গাগুলো দেখতে পায় না। দেখতে পেলে পৃথিবী আচল হয়ে পড়তো।
রাতের খাবার বিলু খেতে পারল না। তার অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে। টি-পটে করে চা দিয়ে গেল এগারোটার দিকে। তখন বিলুর মনে হলে দুজন মিলে এক সঙ্গে বসে চা তো খেতে পারে। এর মধ্যে তো অন্যায় কিছু নেই। এটা হচ্ছে সাধারণ ভদ্রতা। এই সাধারণ ভদ্রতাকে আনিস সাহেব নিশ্চয়ই অন্য কিছু ভেবে বসবেন না।
বিলু দরজা লক করে আনিসের খোজে বের হল।
আনিস দোতলায় ডেকে চাদর পেতে চুপচাপ বসেছিল। তার দৃষ্টি অন্ধকার নদীর দিকে। নদীতে টিমটিমে আলো জ্বলিয়ে মাছ ধরা নৌকা বের হয়েছে। আকাশের নক্ষত্রের মতো মাছধরা নৌকার আলোগুলো ঔজ্জ্বল্য বাড়ছে কমছে। আনিসের দৃষ্টিতে আত্মমগ্ন একটা ভাব যা দূর থেকে দেখেতে ভাল লাগে। কি ভাবছে। এই মানুষটি? তার স্ত্রীর কথা? কতটুকু ভালবাসতো সে তার স্ত্রীকে? সেই রকম ভাল কি অন্য কাউকে বাসা যায় না? না-কি এক জীবনে মানুষ একজনকেই ভালবাসতে পারে?
আচ্ছা সে যদি এখন আনিসের পাশে গিয়ে বসে তাহলে তা কি খুব অশোভন হবে? সে-কি বসবে তার পাশে? হালকা গলায় বলবে আপনার সঙ্গে গল্প করতে এলাম। আপনি কি ভাবছেন?
আনিস সাহেব নিশ্চয় লজ্জা পাওয়া গলায় বলবেন, কিছু ভাবছি নাতো। সে বলবে, কি দেখছেন? তিনি বলবেন, কিছু দেখছি না, তাকিয়ে আছি। সে বলবে, আপনাদের এদিকে খুব হাওয়াতো।
ভেবে রাখা কথাবার্তা কিছুই হলো না। আনিস এক সময় হঠাৎ লক্ষ্য করল বিলু দাঁড়িয়ে। সে উঠে এল। বিলু বলল, আপনার সঙ্গে খুব জরুরি কথা আছে একটু উঠে আসুনতো। আনিস উদ্বিগ্ন গলায় বলল, কোন সমস্যা হয়েছে না-কি?