মেয়েটি বিস্মিত হয়ে বলল, আমাকে বলছেন?
মনসুর থাতমত খেলে বলল, জি।
আপনাকে তো আমি চিনতে পারছি না।
আমি গ্রীন ফার্মেসীতে বসি। ডাক্তার। আপনি এক বোতল স্যাভলন। কিনে নিয়ে গেলেন। আপনার মার হাত কেটে গিয়েছিল।
ও আচ্ছা মনে পড়েছে। মা ভাল আছেন। আমি এখন যাই, কেমন?
মেয়েটি তাকে চিনতে পারল না। এই দুঃখে দ্বিতীয় রাতেও মনসুরের ঘুম এল না। দুটা সিডাকসিন খেয়েও সে সারা রাত জেগে কাটাল। মেয়েটির সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সে এখন জানে। তার নাম মিলি। ভাল নাম ইয়াসমীন। ইকনমিক্সে অনার্স পড়ে–সেকেন্ড ইয়ার। যে বাড়িতে থাকে। সে বাড়ির নাম নিরিবিলি। বাড়ির গেটে একটা সাইবোর্ড ঝুলে, সেখানে লেখা–কুকুর হইতে সাবধান। যদিও সে বাড়িতে কুকুর নেই। মেয়েটি বিকেলে বাড়ির ছাদে একা হাঁটাহাঁটি করে। সে ইউনিভার্সিটিতে যায় সকাল আটটায়। রাস্তার মোড় পর্যন্ত হেঁটে যায়। তারপর রিকশা নেয়। রিকশার হুড তুলে না। সব সময় শাড়ি পরে। মেয়েটার নিশ্চয়ই অনেক শাড়ি। এখন পর্যন্ত এক শাড়ি দুবার পরতে মনুসর দেখেনি। মেয়েটি ফ্ল্যাট স্যান্ডেল পরে। অবশ্যি সে বেশ লম্বা, হিল পরবার তার প্রয়োজন নেই।
মেয়েটি তাকে চিনতে পারে কি-না এটা পরীক্ষা করবার জন্যে আজ সকালে সে মেয়েটার ইউনিভার্সিটিতে যাবার সময় সামনাসামনি পরে গেল। মেয়েটি চোখ তুলে তাকে দেখল। মনসুর কাঁপা গলায় বলল, ভাল আছেন?
মেয়েটি অবাক হয়ে বলল, আমাকে বলছেন?
মেয়েটির চোখে অপরিচিতের দৃষ্টি। লজ্জায় এবং দুঃখে মনসুরের চোখে প্রায় পানি এসে গেল। আর তখন মেয়েটি বলল, ও আচ্ছা। আপনি গ্ৰীন ফার্মেসীর ডাক্তার সাহেব। জি আমি ভাল।
মনসুর হড়বড় করে বলল, আপনার মায়ের সেই কাটাটা কি সেরেছে?
মেয়েটি এই প্রশ্নে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। তারপর আর কোন কথা না বলে রিকশায় উঠে গেল। রাগে এবং লজ্জায় মনসুরের ইচ্ছা করল। লাইট পোষ্টে নিজের মাথা সজোরে ঠুকে দেয়। কেন সে বোকার মত তার মার হাত কাটার কথা জিজ্ঞেস করল? মেয়েটি নিশ্চয়ই তার বোকামী নিয়ে মনে মনে হাসছে। কে জানে বাড়িতে গিয়ে তার মাকেও হয়ত বলবে। কি লজ্জা। কি লজ্জা।
কুদ্দুস সাহেব বললেন, তোমার কি হয়েছে মনসুর বল তো।
কিছু হয়নি।
কিছু হয়নি বললে তো আমি বিশ্বাস করব না। কিছু একটা হয়েছে তো বটেই–রাতে ঘুম হয়?
ঘুমের একটু অসুবিধা হচ্ছে?
বদ হজমও হচ্ছে তাই না?
জ্বি।
মনে হচ্ছে পৃথিবীটা খুব খারাপ জায়গা—ঠিক না?
জ্বি।
সবই খুব পরিচিত লক্ষণ। আমি যখন ইন্টারমিডিয়েট পড়ি তখন আমার মধ্যে এসব লক্ষণ প্ৰকাশ পেয়েছিল। এটা একটা জীবাণু ঘটিত অসুখ।
হ্যাঁ জীবাণু ঘটিত। এ সব জীবাণুর উৎপত্তি হয় কেন এক সুন্দরী তরুণীর চোখে। জীবাণুর নাম হচ্ছে প্ৰেম-জীবাণু। ইংরেজিতে বলে Love bug, ঠাট্টা করছি না ভাই, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। জীবাণুর প্রথম আক্রমণে নার্ভাস সিস্টেম উইক হয়ে যায়। তারপর লিভার ক্ষতিগ্ৰস্ত হয়।
কি সে বলেন।
সত্যি কথা বলছি রে ভাই। খুবই সত্যি কথা— এখন বল মেয়েটা কে?
কেউ না।
সোবাহান সাহেবের মেয়ে মিলি নাতো?
মনসুরের চোখ মুখ লাল হয়ে গেল। কুদ্দুস সাহেব বললেন, আগেই সন্দেহ হয়েছিল এখন তোমাকে দেখে পুরোপুরি নিশ্চিত হলাম। তোমার অবস্থাতো দেখি কাহিল।
মনসুর ক্ষীণ স্বরে বলল, আপনি যা ভাবছেন তা না।
আমি কিছুই ভাবছি না। ভাবাভাবির ফাঁক তুমি রাখনি। এখন আমার উপদেশ শোন, সহজ পাচ্য খাবার খাবে। বেশি করে ডাবের পানি খাবে। সকাল বিকাল লাইট একসারসাইজ। প্ৰেম জীবাণুঘটিত অসুখের কোন চিকিৎসা নেই। জীবাণুগুলো ভাইরাস টাইপ, কোন ওষুধেই কাজ করে না। সময়ে রোগ সারে। টাইম ইজ দ্যা বেষ্ট হিলার। সতীনাথের বিরহের গানগুলো শুনতে পোর। এতেও অনেক সময় আরাম হয়— ঐ যে আমি এধারে তুমি ওধারে, মাঝে নদী কুলকুল বয়ে যায়। টাইপ গান।
ঠাট্টা করবেন না কুদ্দুস ভাই। ঠাট্টা তামাশা ভাল লাগে না।
ঠিক বলেছি, এই সময় ঠাট্টাটা অসহ্য লাগে। কেউ ঠাট্টা করলে ইচ্ছা করে টান দিয়ে জিভ ছিড়ে ফেলি। রোগের কঠিন সংক্রমণের সময় এটা হয়। অল্পতেই নাৰ্ভ ইরিটেটেড হয়।
মনসুর ক্ষীণ স্বরে বলল, আমাকে কি করতে বলেন?
কিছুই করতে বলি না। মিলি অল্প বয়েসী মেয়ে হলে চিঠি লিখতে বলতাম—–এর সেই ষ্টেজ পার হয়ে এসেছে। চিঠি লিখলে সবাই সেই চিঠি পড়ে শুনাবে এবং হাসােহাসি করবে। তুমি যদি আগবাড়িয়ে কথা বলতে চাও, তোমাকে ভাববে ভ্যাবলা। এক মনে আল্লাহকে ডাকা ছাড়া তো আমি আর কোন পথ দেখি না। যাকে বলে আধ্যাত্মিক চেষ্টা। মাঝে মাঝে এই চেষ্টায় কাজ হয়। দৈব সহায় হয়। হঠাৎ হাতে দেখবে মেয়েটা রিকসা এ্যাকসিডেন্ট করেছে। ধরাধরি করে তাকে এইখানে আনা হল। তুমি ফাস্ট এইড দিলে। দেখা গেল অবস্থা সুবিধার না। তুমিই তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে। মেয়েটাকে ব্লাড দিতে হবে। ব্লাড গ্রুপ এ পজেটিভ। দেখা গেল তোমারও তাই। তুমি ব্লাড দিলে। মেয়েটি করুণ গলায় বললে, আপনি আমার জন্যে অনেক করলেন। আপনাকে ধন্যবাদ। তুমি গাঢ় গলায় বললে, ধন্যবাদ পরে হবে। আগে সুস্থ হয়ে উঠ।
মনসুর বলল, চুপ করুনতো কুদ্দুস সাহেব, আপনার কথা শুনতে ভাল व्लां96छ না।
কুদ্দুস সাহেব বললেন, সেটা তোমার মুখ দেখেই বুঝতে পারছি। করব কি বল, কথা বলা হয়ে গেছে। অভ্যাস। তোমার অবস্থা দেখে খারাপও লাগছে। আল্লাহর উপর ভরসা রাখা। তাতে যদি কিছু হয়।