মেঝেতে খবরের কাগজ বিছায়ে ঘুমানো যতটা কষ্টকর হবে বলে ভাবা গিয়েছিল ততটা কষ্টকর মনে হচ্ছে না। মাথা নিচে শান্তিনিকেতনি ব্যাগ দিয়ে ফরিদ বেশ আরাম করেই শুয়েছে— তারপাশে কাদের। কাদের ঘুমিয়ে পড়েছে। ফরিদের ঘুম আসছে না। সে চোখের উপর কবিতার বইটা ধরে রেখেছে। কবিতা পড়তে নেহায়েত মন্দ লাগছে না।
ফরিদের মাথার কাছে এক বুড়ো শুয়েছে। সে স্টেশনেই ভিক্ষা করে। সেও ফরিদের মতাই জেগে আছে। এক সময় বলল ভাইজান কি পড়েন?
ফরিদ বলল, কবিতা।
এট্টু জোর দিয়ে পড়েন— আমিও হুনি।
আপনার সম্ভবত ভাল লাগবে না।
লাগব। ভাল লাগব।
ভাল লাগলে শুনুন, এই কবিতাটা প্রেমেন্দ্ৰ মিত্রের লেখা।
হিন্দু?
জি হিন্দু।
মালাউনের কবিতা কি ভাল হইব? আইচ্ছা পড়েন।
কবিতার নাম, কাক ডাকে–
খাঁ খাঁ রোদ নিস্তব্ধ দুপুর;
আকাশ উপুড় করে ঢেলে দেওয়া
অসীম শূন্যতা,
পৃথিবীর মধ্যে আর মনে—
তারই মাঝে শুনি ডাকে
শুষ্ক কণ্ঠ কা কা!
গান নয়, সুর নয়,
প্ৰেম, হিংসা, ক্ষুধা— কিছু নয়,
সীমাহীন শূন্যতা শব্দমূর্তি শুধু।
কবিতা পড়তে পড়তেই ফরিদ ঘুমিয়ে পড়ল। কবিতা পাঠের কারণেই হোক, কিংবা সারাদিনের পরিশ্রমের কারণেই হোক খুব ভাল ঘুম হল। যাকে বলে একঘুমে রাত কাবার।
ঘুম ভাঙল কাদেরের চিৎকারে।
সব্বনাস হইছে মামা—উঠেন।
ফরিদ উঠল। তেমন কোন সর্বনাশের ইশারা সে দেখল না। কাদের চাপা গলায় বলল, চোর বেবাক সাফ কইরা দিছে।
সাফা করে দিয়েছে মানে?
ভাল কইরা নজর দিয়া দেখেন মামা।
আরো তাইতো!
ফরিদের শান্তিনিকেতনি ব্যাগ নেই। কাদেরের টিনের ট্রাংক নেই। শুধু তাই না, সবচেয়ে যা আশ্চর্যজনক হচ্ছে, চোর ফরিদের গা থেকে পাঞ্জাবী এবং কাদেরের শার্ট খুলে নিয়ে গেছে। এই বিস্ময়কর কাজ চোর কি করে করল কে জানে। অত্যন্ত প্ৰতিভাবান চোর। এটা মানতেই হবে। ফরিদ বলল, ভাল হাতের কাজ দেখিয়েছে রে কাদের, I am impresed.
কাদের শুকনো স্বরে বলল, অল্পের জইন্যে ইজ্জত রক্ষা হইছে মামা। টান দিয়া যদি লুঙ্গী লইয়া যাইত তা হইলে উপায়টা কি হইত চিন্তা করেন।
ফরিদ শিউরে উঠল। এই সম্ভাবনা তার মাথায় আসেনি। সে ক্ষীণ স্বরে বলল, আমার পরণে প্যান্ট। ব্যাটা নিশ্চয়ই প্যান্ট নিতে পারত না। কি বলিস কাদের?
যে শার্ট খুইল্যা নিতে পারে সে প্যান্টও খুলতে পারে।
তাওতো ঠিক। মাই গড। আমারতো চিন্তা করেই গায়ে ঘাম দিচ্ছে। কি করা যায় বলতো? রেলওয়ে পুলিশকে ইনফর্ম করব?
কাদের অত্যন্ত বিরক্ত গলায় বলল, চুপ করেন তো মামা?
জিন্দেগীতে কোনদিন শুনেছেন পুলিশ চোর ধরছে? আল্লাহতালা পুলিশ বানাইছে ঘুস খাওনের জইন্যে।
বলিস কি?
দেশ থাইক্যা পুলিশ তুইল্যা দিলে চুরি ডাকাতি অর্ধেক কইম্যা। যাইব। গরিব একটা কথা কইছে। কথাটা চিন্তা কইরা দেখবেন।
চোর সবই নিয়ে গেছে। তবে কবিতার বই ফেলে গেছে। ফরিদ কবিতার বই হাতে নিল। তবে কবিতার পড়ার ব্যাপারে সে এখন আর কোন আগ্ৰহ বোধ করছে না। প্রচণ্ড ক্ষুধা বোধ হচ্ছে। খালি পেটে কাব্য, সংগীত এইসব জমে না কথাটা বোধ হয় ঠিকই।
কাদের।
জ্বি মামা।
খাওয়া দাওয়ার কি ব্যবস্থা করা যায় বলতো।
আর খাওয়া দাওয়া।
নাশতা তো খেতে হবে।
দুই গেলাস পানি খান। পানি হইল ক্ষিধার বড় অষুধ।
ফরিদ পর পর তিন গ্রাস পানি খেল। তার ক্ষিধের তেমন কোন উনিশ বিশ ठूल •ा।
সোনালি ফ্রেমের চশমা পড়া প্রফেসর টাইপ এক যাত্রী যাচ্ছে। চিটাগাং থেকে এসেছে মনে হচ্ছে। ফরিদ কবিতার বই হাতে এগিয়ে গেল, নরম গলায় বলল, ভাই শুনুন আমার কাছে চমৎকার একটা কবিতার বই আছে। বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত আধুনিক কবিতা। নাম মাত্র মূল্যে বইটি ছেড়ে দিচ্ছি। আপনি কি আগ্রহী?
লোকটি অত্যন্ত বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকাল, জবাব দিল না। তবে ফরিদ পরের এক ঘণ্টার মধ্যে বইটি পনেরো টাকায় বিক্রি করে ফেলতে সক্ষম হল। বইটি কিনেছে কাল চশমা পরা রূপবতী একজন তরুণী। কাদের তার হ্যান্ডব্যাগ এগিয়ে দিয়েও পাঁচ টাকা পেল।
বিলু এসে বলল
বিলু এসে বলল, আনিস সাহেব। আপনাকে বাবা একটু ডাকছেন। আনিস লিখছিল। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। বিলু বলল, আপনি আপনার কাজ সেরে আসুন। এমন জরুরি কিছু নয়।
আনিস বলল, আমার কাজটাও তেমন জরুরি কিছু না। পত্রিকায় দেখলাম আপনাদের মেডিকেল কলেজ খুলে যাচ্ছে।
হ্যাঁ খুলছে। অল্প কিছুদিন ক্লাস হবে। আবার বন্ধ হয়ে যাবে।
আপনার, মনে হচ্ছে যাবার খুব একটা ইচ্ছা নেই?
না নেই। তাছাড়া বাসায় এলে আর কোথাও যেতে ইচ্ছা করে না।
আপনার পুত্ৰ-কন্যা কোথায়?
ওরা খাটের নিচে।
ওখানে কি করছে?
জানি না। নতুন কোন খেলা বের করেছে বোধ হয়।
বিলু নিচু হয়ে দেখতে চেষ্টা করল। টগরের হাতে কাচি। সে কাটাকুটি করছে বলে মনে হয়। চোখে চোখ পড়তেই টগরের ইশারায় বিলুকে চুপচাপ থাকতে বলল।
বিলু আনিসের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি চলে যান। আমি ওদের সঙ্গে খানিকক্ষণ গল্প করি।
গল্প করতে হলে খাটের নিচে যেতে হবে। ওরা সেখান থেকে বেরুবে বলে মনে হয় না।
আনিস সার্ট গায়ে দিয়ে নিচে নেমে গেল।
সোবাহান শাহেবের শরীর বিশেষ ভাল নয়। তিনি চুপচাপ শুয়ে আছেন। আনিসকে দেখে উঠে বসলেন। আনিস বলল, কেমন আছেন স্যার?
ভাল। তুমি কেমন?
আমিও ভাল।
বস। ঐ চেয়ারটায় বস। মনটা একটু অস্থির হয়ে আছে।