জ্বি করে! মিলি আফাও করে।
ইয়েস। এনাদার প্লাস পয়েন্ট। মিলিও বলবে- বাবা, মামার জন্যে আমার মনটা খারাপ লাগছে। এতে দুলাভাই আরও বিষগ্ন হবেন। ক্রমে ক্ৰমে দুপুর হয়ে গেল খাবার টাইম। টেবিলে খাবার দেয়া হয়েছে, আমার অভাব সবাই তীব্রভাবে অনুভব করছে। দুলাভাই, অপরাধবোধে আক্রান্ত। এর মধ্যে তোর অভাবও অনুভব করা যাচ্ছে।
সত্যি?
অবশ্যই। দোকান থেকে এটা ওটা আনা দরকার। হাতের কাছে কেউ নেই। দুলাভাই তামাক খাবেন- সেই তামাক সাজার কাজটা তোর চেয়ে ভাল কেউ পারে না।
কাদের হাসি মুখে বলল, কথা সত্য।
কি বলছি মন দিয়ে শোন। এই যখন অবস্থা তখন হঠাৎ ঘরের কলিং বেজে উঠল-ক্রীং ক্রীং ক্রং। সবার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল। সবাই ভাবছে আমরা বুঝি চলে এলাম। দরজা খুলে দেখা গেল তুই একা দাঁড়িয়ে আছিস।
আমি?
হ্যাঁ তুই। তুই গম্ভীর গলায় বলবি— আমাকে দেখে ভাববেন না যে আমরা ফেরত এসেছি। মামা কঠিন লোক, একবার ঘর থেকে বের হলে সে আর ফেরে না। মামা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি এসেছি মামার একটা বই নিতে। মামা বই ফেলে গেছেন। তোর কথা শেষ হওয়া মাত্র ঘরে খানিক নীরবতা। বিলু তাকিয়ে আছে বাবার দিকে, মিলি তাকিয়ে আছে বাবার দিকে। তাদের দৃষ্টিতে নীরব অনুনয় ঝড়ে পড়ছে। দুলাভাই তখন বলবেন, যাই আমি ফরিদকে নিয়ে আসি। দুলাভাই বের হয়ে এলেন এবং হাত ধরে আমাকে টেনে নিয়ে ঘরে ঢুকবেন। যাকে বলে গ্রেসফুল এন্ট্রি। বুঝতে পারলি?
পারলাম। আপনের বুদ্ধির কোন সীমা নাই মামা। আরেক কাপ চায়ের কথা কই?
আচ্ছা বল।
কাদের সত্যি সত্যি অভিভূত। এমন অসাধাণ বুদ্ধির একজন মানুষ জীবনে কিছু বলতে পারছে না কেন তা ভেবে এই মুহুর্তে সে কিছুটা বিষণ্ণ বোধ করছে।
নিরিবিলি বাড়ির গেটের বাইরে ফরিদ হাঁটাহাঁটি করেছে। কাদের গিয়েছে বই চাইতে। কিছুক্ষণের মধ্যে তাদের ফিরে আসতে দেখা গেল। তার মুখ পাংশু বর্ণ।
ফরিদ বিস্মিত হয়ে বলল, ব্যাপার কিরে?
ব্যাপার কিছু না। যে ভাবে বলতে বলেছিলাম বলেছিলি?
হুঁ।
দুলাভাই কি বললেন?
বললেন- বই নিয়ে বিদায় হ।
ফরিদ বিস্মিত হয়ে বলল, বলিস কি?
যা ঘটনা তাই বললাম। এই নেন আপনের বই।
কাদেরের হাতে বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত সবুজ মলাটের আধুনিক কবিতা।
ফরিদ নিচু গলায় বলল, সমস্যা হয়ে গেল দেখছি।
কাদের কিছু বলল না। তার খুবই মন খারাপ হয়েছে। ঐ ফাজিল কোকিলটা এখনো ডাকছে-কুহু কুহু। রাগে গা-টা জুলে যাচ্ছে।
ফরিদ বলল, কাদের কি করা যায় বলত?
কাদের থু করে একদলা থুথু ফেলল। তার কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।
দুপুর এবং রাত এই দুবেলা খাবারের টাকা কি তোর কাছে আছে?
আছে।
তাহলে খামাখা এত দুশ্চিন্তা করছি কেন? রাতটা আগে পার করি। তারপর ঠাণ্ডা মাথায় ভেবেচিন্তে কোন পরিকল্পনা বের করতে হবে। আমি এই মুহূর্তে কোন সমস্যা দেখছি না।
সমস্যা দেখা দিল রাতে। কোন সস্তা দরের হোটেলে রাতটা কাটানো যায় কিন্তু কাদের টাকা খরচ করতে চাচ্ছে না। কতদিন বাইরে বাইরে ঘুরতে হবে কে জানে। হাতে কিছু থাকা দরকার। মামার উপর এখন সে আর বিশেষ ভরসা। করতে পারছে না। এখন মনে হচ্ছে তার বুদ্ধিটাই ভাল ছিল— পায়ের উপর পড়ে যাওয়া এবং কান্না কান্না গলায় বলা— মাফ করে দেন।
ঠিক হল রাত কাটানো হবে কমলাপুর রেল স্টেশনে। খবরের কাগজ বিছিয়ে তার উপর শুয়ে থাকা। এমন কোন কঠিন ব্যাপার না। তবে মশা একটা বড় ধরনের সমস্যা হিসেবে দেখা দিতে পারে। পরে বলাটা ঠিক হবে না ইতোমধ্যেই দেখা দিয়েছে। চারদিকে মশা। স্ত্রী মশারাই কেবল মানুষের রক্ত খায়। কাজেই ধার নিতে হবে যে মশাগুলো তাকে কামড়াচ্ছে তারা স্ত্রী জাতি ভুক্ত। এদের প্রত্যেককেই বেশ স্বাস্থ্যুবতী মনে হচ্ছে। ফরিদের ধারণা ইতোমধ্যে তার শরীর থেকে কোয়াটার কেজির মত রক্ত পাচার হয়ে গেছে।
কাদের।
জ্বি মামা।
মশার হাত থেকে বাচার জন্যে একটা বুদ্ধি বের করেছিরে —কাদের।
কাদের কিছু বলল না। সে অত্যন্ত বিমর্ষ বোধ করছে। মামার কোন বুদ্ধির উপরই সে এখন আর আস্থা রাখতে পারছে না। ফরিদ উৎসাহের সঙ্গে বলল, আমরা কি করব জানিস? আমরা মশাদের টাইম দেব। আমরা শোব। এমন জায়গায় যেখানে অনেক লোকজন শুয়ে আছে। কিন্তু এখন শোব না। এখন শুধু হাঁটাহাঁটি করব। ধর রাত একটা পর্যন্ত। ইতোমধ্যে মশারা তাদের প্রয়োজনীয় রক্ত অন্যদের কাছে থেকে সংগ্রহ করে রাখবে। আমরা যখন ঘুমুতে আসব তখন তাদের ডিনার পর্ব শেষ। বুঝতে পারলি ব্যাপারাটা?
পারছি।
সবই বুদ্ধির খেলা বুঝলি। সব সমস্যার সমাধান হচ্ছে মাথায়। মশা সমস্যার কি সহজ সমাধান করে দিলাম দেখলি?
দেখলাম।
তোর মনটা মনে হচ্ছে খারাপ।
ঘরে বিছানা, মশারি, বালিশ থুইয়া মাটির মধ্যে ঘুম।
কিন্তু স্টেশনে গণমানুষের সঙ্গে শুয়ে থাকারও তো একটা আনন্দ আছে। ওদের কাতারে চলে আসতে পারছি এটা কি কম কথা? Have nots ব্দের চোখের সমনে খেতে পাচ্ছি। আশ্রয়হীনদের দুর্দশা দেখছি। ওদের সুখ-দুঃখে৷ অংশ নিচ্ছি- এটাওতো কম না।
মামা চুপ করেন তো।
তোর মেজাজ মনে হচ্ছে অতিরিক্ত খারাপ। এটাতো ভাল কথা না। জীবনকে দেখতে হবে। জানতে হবে। এদের নিয়ে আমি একটা ছবি করব বলেও ভাবছি। ছবির নাম তাহারা। ছিন্নমূল মানুষদের ছবি। অপেনিং শট থাকবে একটা শিশুর মুখ। ওকি চলে যাচ্ছিস কেন?