দুই অক্ষরে একটা শব্দ সিরি বললেই সব সমস্যার সমাধান? তুই ভাবিস কি আমাকে?
মামা তুমি শুধু শুধু রাগ করছ। তোমাকে আমি খুবই পছন্দ করি এবং তুমি নিজেও তা ভাল করেই জান।
পছন্দ করিস আর না করিস- কাল ভোর থেকে তোরা কেউ আমাকে দেখবি না। আমি পথে নেমে যাচ্ছি।
পথে নেমে যাচ্ছি মানে?
রাস্তায় রাস্তায় ঘুরব। বাড়িতে বসে এই অপমান সহ্য করব না। যথেষ্ট সহ্য করেছি। মানুষের সহ্য শক্তির একটা সীমা আছে। এই সীমা অতিক্রম করা হয়েছে। দেয়ালে আমার পিঠ ঠেকে গেছে বিলু।
কাদের দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, অখন দেওয়াল ভাঙা বাইর হওন ছাড়া আর উপায় নাই আফা।
তুইও যাচ্ছিস না-কি?
হুঁ-মামারে একলা ছাড়ি ক্যামনে।
ভাল। যা কিছুদিন বাইরে থেকে আয়।
ফরিদ পাশ ফিরে শুতে শুতে বলল, এই রাতাই এ বাড়িতে আমাদের শেষ রাত। দ্য লাষ্ট নাইট।
ফরিদের কথায় কোন গুরুত্ব এ বাড়িতে কেউ দেয় না। বিলুও দিল না। কিন্তু পরদিন ভোরবেলা সত্যি সত্যি দেখা গেল ফরিদ এবং কাদের কাধে শান্তিনিকেতনি ব্যাগ ঝুলিয়ে ঘর থেকে বেরুচ্ছে। সোবাহান সাহেবের সঙ্গে তাদের দেখা হল বারান্দায়। ফরিদ বলল, দুলাভাই চললাম। যদি কোন অপরাধ করে থাকি তাহলে ক্ষমা করে দেবেন। যদিও জানি তেমন কোন অপরাধ হয় নি।
সোবাহান সাহেব বললেন, কোথায় যাচ্ছ?
রাস্তায় আর কোথায়। আমার ঠিকানাতো দুলাভাই রাজপথে। তবে আপনি যদি এখনো নিষেধ করেন তাহলে একটা সেকেন্ড থট দিতে পারি। থেকে যেতে পারি।
সোবাহান সাহেব অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন— তোমাকে যেতে নিষেধ করব কেন? আমি নিজেইতো তোমাকে যেতে বলেছি।
তাহলে যাচ্ছি দুলাভাই।
আচ্ছা।
খোদা হাফেজ।
খোদা হাফেজ।
সুন্দর সকাল। —তাই না দুলাভাই?
হ্যাঁ সুন্দর সকাল।
তাহলে রওনা দিচ্ছি?
আচ্ছা।
কাদের বলল, বাম পাটা আগে ফেলেন মামা। চিরজন্মের মত বাইর হইতে হইলে বাম পা আগে ফেলতে হয়।
ফরিদ বাঁ পা আগে ফেলল। কুহু কুহু করে একটা কোকিল ডাকছে। এই বাড়ির বাগানে একটা পাগলা কোকিল আছে। বসন্ত কাল ছাড়া অন্য সব সময় সে ডাকে।
কোকিলের ডাকের কারণেই কি-না কে জানে ফরিদের বুক হু হু করতে লাগল। তার মনে হল মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করাটা উচিত হয়নি। তার উচিত ছিল পাখি হয়ে জন্মানো। সেসব পাখি যারা ঘর বাধতে পারে না। যেমন কোকিল। তাহলে ঘর ছাড়ার কষ্টটা পেতে হত না। যার ঘর নেই তার ঘর ছাড়ার কষ্টও নেই। পাগলা কোকিল ক্ৰমাগত ডেকে যাচ্ছে কুহু কুহু।
আধা ঘণ্টার মতো হয়েছে।
দুজন হাঁটছে সমান তালে। এক সময় কাদের শুকনো গলায় বলল, আমরা যাইতেছি কই?
ফরিদ থমকে দাঁড়িয়ে বিস্মত গলায় বলল, কি অদ্ভুত কেইনসিডেন্স। আমিও ঠিক এই মুহুর্তে এই কথাটাই তোকে জিজ্ঞেস করব বলে ভাবছিলাম।
আমারে জিগাইলে ফয়দা কি? আমি হইলাম। একটা চাকর মানুষ।
এই কথা ভুলে যা কাদের। এখন আমরা দুজনই সমান। তুই যা আমিও তা। দু জনই পথের মানুষ। রাজপথে আমাদের দুজনকে এক কাতারে নিয়ে এসেছে।
জ্ঞানের কথা অখন আর ভাল লাগতেছে না। মামা। ক্ষিধা চাপছে।
ক্ষুধা-তৃষ্ণা এইসব স্কুল জিনিস এখন আমাদের ভুলে যেতে হবে রে কাদের। ম্যানিব্যাগ ফেলে এসেছি।
কন কি -সাড়ে সর্বনাশের কথা।
অবশ্যি নিয়ে এলেও কোন ইতর বিশেষ হত না। মানি ব্যাগে টাকা ছিল না। তোর কাছে কিছু আছে?
কাদের জবাব দিল না। সে একেবারে খালি হাতে আসেনি। তবে সেই কথা মামাকে বলা উচিত হবে কিনা বুঝতে পারছে না। ফরিদ বলল, তোর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে খালি হাতে আসিস নি। দ্যাটস ভেরি গুড। আয় আপাতত চা খাওয়া যাক।
চা খাইয়া টেকা নষ্ট করনের সার্থকতা কি মামা?
চা খেতে খেতে ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি পর্যালোচনা করব। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটা পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। রাতে কোথায় ঘুমুব এই নিয়েও ভাবতে হবে।
চলেন ফেরত যাই।
ফরিদ বিস্মিত হয়ে বলল, কি অদ্ভুত কেইনসিডেন্স। আমিও ঠিক এই মুহুর্তে এই কথাটাই বলব বলে ভাবছিলাম। এর ভেতর থেকে যে জিনিসটা দিবালোকের মত স্পষ্ট হল সেটা কি জানিস?
কাদের বিরস মুখে বলল, জি না।
যে জিনিস স্পষ্ট হল তা হচ্ছে— পথের মানুষ সবাই একই ভাবে চিন্তা করে। ব্যাপারটা আমি চট করে বললাম, কিন্তু যা বললাম তা গভীর দার্শনিক চিন্তার বিষয়। চল চা খাই।
চলেন।
চা খেতে খেতে ফরিদ বলল, যাব কি ভাবে তা নিয়েও চিন্তা করা দরকার। রি এন্ট্রি কি ভাবে হবে তা নিয়ে ভাবতে হবে।
ভাবনের কিছু নাই। গিয়ে পরও ধরলেই হইব। পাওডাত ধইরা বলতে হইব মাফ চাই।
চুপ কর গাধা। পা ধরাধরির কিছুই নেই। গ্রেসফুল এন্ট্রির ব্যবস্থা করছি। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে দে। আরেক কাপ চা দিতে বল- চিনি বেশি। রক্তে ক্যাফিনের পরিমাণ বাড়াতে হবে। ক্যাফিন চিন্তার সহায়ক।
ফরিদকে আরেক কাপ চা দেয়া হল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মুখে মৃদু হাসি দেখা গেল। কাদের বলল, কিছু পওয়া গেছে মামা?
অবশ্যই।
কি পাইলেন?
পারিবারিক সদস্যদের সাইকোলজি নিয়ে চিন্তা করে বুদ্ধিটা বের করেছি। আমরা চলে আসার পর বাসার পরিস্থিতি কি হয়েছে চিন্তা কর। প্রথমে দুলাভাইয়ের কথা ধরা যাক। উনার অসংখ্য ক্ৰটি সত্ত্বেও উনি যে একজন ভালমানুষ এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। উনার মনের অবস্থা কি? উনার মন হয়েছে। খারাপ। খুব খারাপ। মনে মনে বলছেন— এই কাজটা কি করলাম? কাজটা ঠিক হয় নি। এর মধ্যে বিলু এসে কান্না কান্না গলায় বলেছে— বাবা, তুমি মামাকে বের করে দিলে? বেচারা এখন কোথায় ঘুরছে কে জানে। বিলু যে এই কথা বলবে তা জানা কথা কারণ মেয়েটা আমাকে খুবই স্নেহ করে। করে না?