আনিস সাহেবকে দেখলেই বিলুর ঐ স্যারের কথা মনে পড়ে। কেন পড়ে বিলু ঠিক জানে না। দুজনের মধ্যে কোনই মিল নেই। তবু যেন কি একটা মিল আছে। বিলু ছােট্ট নিঃশ্বাস ফেলে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়াল। আনিস সাহেব বলছেন, আচ্ছ এখন তোমরা বলতো কোন প্ৰাণী অন্ধকারে সবচে ভাল দেখতে পায়।
নিশা বলল, অন্ধকারে শুধু বিড়াল দেখতে পায়।
টগর বলল, বাদুর এবং পেচা দেখতে পায়।
এইসব প্ৰাণীদের মধ্যে সবচে ভাল কে দেখতে পায়?
জানি না বাবা।
প্রশ্ন করলেই চট করে জানি না বলা ঠিক না টগর। অনেকক্ষণ প্রশ্নটা নিয়ে ভাববে, তারপরেও যদি না পার তাহলে বলবে বলতে পারছি না।
নিশা বলল, আমার মনে হয় অন্ধকারে সবচে ভাল দেখতে পায় বিড়াল। আমারটা হয়েছে বাবা?
না হয় নি। অন্ধকারে সবচে ভাল দেখতে পায় মানুষ। কারণ সে অন্ধকারে বাতি জ্বালানোর কৌশল জানে। অন্য কোন প্ৰাণী তা জানে না। কাজেই মানুষ অন্ধকারে সবচে ভাল দেখতে পায়।
টগর বলল, জোনাকি পোকাওতো অন্ধকারে বাতি জ্বালাতে পারে।
আনিস একটু হকচকিয়ে গেল। টগরের এই উত্তর সে আশা করেনি। আনিস বলল, জোনাকি বাতি জ্বালাতে পারে তা ঠিক। শুধু জোনাকি না। অন্ধকারে সমুদ্রের অনেক মাছ। যেমন ইলেকট্রিক ঈল বাতি জ্বালাতে পারে। কিন্তু এই বাতি প্রকৃতি তার শরীরে দিয়ে দিয়েছে। অন্ধকার হলে আপনাতে জ্বলে উঠে। প্রকৃতি মানুষের শরীরে এমন কিছু দিয়ে দেয় নি। বাতি জ্বালানোর কৌশল মানুষকে বুদ্ধি করে বের করতে হয়েছে। জোনাকি পোকা এবং ঈল মাছের সঙ্গে এইখানেই মানুষের তফাৎ।
নিশা বলল, প্রকৃতি কি বাবা?
আনিস আবার হকচাকিয়ে গেল। প্রকৃতি কি তার উত্তর তিন ভাবে দেয়া যায়। আস্তিকের দৃষ্টিকোণ থেকে, নাস্তিকের দৃষ্টিকোণ থেকে এবং এসকেপিস্টের দৃষ্টিকোণ থেকে। সে কোনটা দেবে? কোনটা দেয়া উচিত? আনিস বলল, গল্পগুজব আজকের মত শেষ। বাবারা এবার ঘুমুতে যাবার পর্ব। আমি এক থেকে কুড়ি পর্যন্ত গুনব। এর মধ্যে তোমরা পানি খেয়ে বাথরুম পর্ব শেষ করে ঘুমুতে যাবে। এক-দুই-তিন-চার-পাচ -ছয়…
বিলু, নিঃশব্দে নিচে নেমে এল। পথে পুতুলের সঙ্গে দেখা। সে ট্রেতে চা বিসকিট নিয়ে উপরে উঠছে। আনিসের চা। মনে হচ্ছে আনিসের সঙ্গে এই মেয়েটির এক ধরনের সহজ সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। প্রায়ই সে উপরে চা নিয়ে আসে। সহজ সম্পর্কের আড়ালে অন্য কিছু নেইতাে? বিপত্নীক তৃষিত এই পুরুষ, যৌবনের দুয়ারে এসে দাঁড়ানো সরলা একজন তরুণী। প্রকৃতি কি তার নিজস্ব নিয়মে এদের কাছাকাছি নিয়ে আসবে না?
পুতুল
জ্বি আপা।
আনিস সাহেবের জন্য চা নিয়ে যাচ্ছ বুঝি?
জি। আপনে আমারে কিছু বলবেন আফা?
না কিছু বলব না। তুমি যাও।
বিলু, মুখে বলছে কিছু বলবে না। কিন্তু তার মন চাচ্ছে অনেক সময় নিয়ে পুতুলকে সে গুছিয়ে নারী-পুরুষ সম্পর্কের জটিল তার কথাগুলো বলে। এই জটিলতা ভয়াবহ জটিলতা। মানুষ তার সবটা জানে না। কিছুটা জানে। ভালবাসার মূল কারণগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে শরীর। ভালবাসায় শরীর ছাড়াও অনেক কিছু আছে। সেই অনেক কিছু কি? কেউ কি জানে? আচ্ছা আনিস সাহেব নিজে কি জানেন? তাকে দেখেতো মনে হয় তিনি অনেক কিছু জানেন। অনেক কিছু নিয়ে ভাবেন। এই সব নিয়েও নিশ্চয়ই ভেবেছেন। একদিন হুট করে জিজ্ঞেস করে ফেললেই হয়।
বিলু একতলায় নেমে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে খানিক হাঁটল। তার মন বেশ খারাপ হয়েছে। কোন কিছুতেই মন বসছে না। ফরিদের ঘরে আলো জুলছে। বিলু মামার ঘরে উঁকি দিল।
মেঝেতে কাদের গালে হাত দিয়ে বসে আছে। ফরিদ শুয়ে আছে বিছানায়। দুজনকেই খুব চিন্তামগ্ন মনে হচ্ছে। বিলু বলল, কি হয়েছে মামা?
কিছু হয় নি।
মন খারাপ?
না।
ভেতরে এস তোমার সঙ্গে কি খানিকক্ষণ গল্প-গুজব করা যাবে?
ইচ্ছা করলে যাবে।
বিলু, ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, আচ্ছা মামা দেখি তোমার কেমন বুদ্ধি। একটা ধাঁধার জবাব দাও তো। বলতো প্ৰাণীদের মধ্যে কোন প্ৰাণী অন্ধকারে সবচে ভাল দেখতে পায়?
ফরিদ অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলল, মানুষ আবার কে? অন্ধকারে মানুষ ফস করে একটা টর্চ লাইট জ্বেলে দেয়। এইসব লো-লেভেল ইন্টেলিজেন্সের কথাবার্তা আমার সঙ্গে একবারেই বলবি না।
তুমি এত রাগ কেন মামা?
রাগ না। মনটা খারাপ।
বাবা আবার কিছু বলেছে?
হুঁ।
কি বলেছে।
কি হবে এই সব শুনে।
বল না শুনি।
ফরিদ কিছু বলল না। কাদের ফোঁস করে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। বিলু বলল, বাবা কি অন্যায় কিছু বলেছেন?
অন্যায় তো বটেই। দুলাভাই আমার বুদ্ধিবৃত্তি সম্পর্কে অতি কুৎসিত মন্তব্য করেছেন। দুলাভাই বলেছেন- আমার মাথায় ব্রেইন বলেই কিছু নেই। ব্রেইনের বদলে আমার মাথায় আছে শুধু ডাবের পানি। শুনে আমার মনটাই খারাপ হয় গেল। একটা লোক যদি কাকটিনিডিয়াসলি বলতে থাকে আমার মাথায় কিছু নেই তখন কেমন লাগে বলতো? তারপরেও কথা আছে- আমার মাথায় কিছু নেই ভাল কথা— তাই বলে ডাবের পানি থাকবে কেন? এটাতো অত্যন্ত অপমান সূচক কথা। ডাবের পানি বলায় যত মাইন্ড করেছি- মাথাভর্তি গোবর বললে এত মাইন্ড করতাম না।
বিলু হেসে ফেললো। ফরিদ ক্ষিপ্ত গলায় বলল, হাসছিস কেন? একজন ভাবছে আমি একটা ডাবের মধ্যে হাসি তামাশার কি আছে? না-কি তোরও ধারণা আমি একটা ডাব?
বিলু, লজ্জিত গলায় বলল, সরি মামা।