এমদাদ সাহেব তাঁর এ বাড়িতে আসার কারণ পুরোপুরি ব্যাখ্যা করার জন্য যে দিনটি বেছে নিল সে দিনটি মঙ্গলবার- সত্য দিবস।
সকাল বেলা সোবাহান সাহেব বাগানে হাটছিলেন। এমদাদ সেখানেই তাকে ধরল। সোবাহান সাহেব বললেন, কিছু বলবেন?
এমদাদ বিনয়ে গলে গিয়ে বলল, অবশ্যই বলব। আপনারে বলবনাতো বলব কারে? আপনে হইলেন বটবৃক্ষ।
গৌরচন্দ্রিকার দরকার নেই। কি বলতে চান বলে ফেলুন।
এমদাদ হাত কচলে বলল, নাতনীটার একটা ব্যবস্থা করার জন্য জনাবের কাছে আসলাম। জানি— মুখ ফুটে এবার বলে ফেলতে পারলে সব সমস্যার সমাধান। বলেই ফেললাম। এখন আপনি হইলেন বটবৃক্ষ। যা করবার আপনি করবেন। আমার কাজ শেষ।
আমি ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারছি না। কার কি ব্যবস্থার কথা বলছেন?
পুতুলের একটা বিবাহ দেয়ার কথা বলতেছি।
পুতুলের বিয়ে? কি বলছেন। আপনি? ওতো বাচ্চা একটা মেয়ে। মেট্রিক পাস করেছে এখন পড়াশোনা করবে।
মেয়েছেলে পড়াশোনা করে কি করবে জনাব? মেয়েছেলেকে তৈরি করা হয়েছে সন্তান পালনের জন্য।
সোবাহান সাহেব অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, এসব বলছে কে আপনাকে? মেয়েরা কি সন্তান তৈরির মেশিন না-কি?
বলতে গেলে তাই। বুঝতেছি আপনার শুনতে খারাপ লাগতেছে তবে এইগুলো হলো সত্য কথা। আজ মঙ্গলবার সত্য দিবস। মিথ্যা বলে পাপ করব আমি এমন লোক না। তা ছাড়া জনাব আমি বেশি দিন বাঁচব না। মৃত্যুর আগে দেখতে চাই নাতনীটার একটা গতি হয়েছে। এইটা দেখে যেতে পারলে মরেও শান্তি।
সোবাহান সাহেবের চোখের দৃষ্টি থেকে বিরক্ত ভাবটা গেল না। বরং আরো দৃঢ় হল। তিনি কঠিন গলায় বললেন, এত অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ের পক্ষপাতি আমি না। আমার ফিলসফি হচ্ছে- মেয়েরা পুরোপুরি স্বাবলম্বী হবার পর বিয়ে করবে। পুতুলের পড়াশোনার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আমার এখানে থেকেই সে পড়াশোনা করতে পারে। তাছাড়া তার নিজেরও সে রকম ইচ্ছা। আমাকে কিছু বলেনি। তবে আমার স্ত্রীকে বলেছে।
এমদাদের মুখ হা হয়ে গেল। পুতুল তাকে না জানিয়ে ভেতরে ভেতরে এই কাজ করছে তা সে কল্পনা করেনি। এমদাদ বলল, পড়াশোনার কথা যে বলছেন জবান সেতো বিয়ের পরেও হতে পারে। একটা ভাল ছেলে যদি পাওয়া যায়। সে বিয়ের পরেও মেয়ে পড়াবে।
সে রকম ছেলে পাবেন কোথায়?
এমদাদ নিচু গলায় বলল, হাতের কাছে একজন আছে। আপনি মুখে একটা কথা বললে বিয়েটা হয়ে যায়। আমি নিশ্চিন্তে মরতে পারি।
সেই ছেলে কে?
মনসুর আমাদের ডাক্তার।
ডাক্তার?
জ্বি। পুতুলারে তার খুবই পছন্দ। সব সময় দেখি কুটুর কুটুর গল্প করে।
তাই না-কি?
এক রাতে মনসুর এই বাড়িতে ছিল। ঐ রাতে পুতুল নিজেই ভাত টাত বেড়ে খাওয়াল। তার থেকে বুঝলাম পুতুলের নিজেরও ইচ্ছা আছে। এখন আপনি যদি শুধু একটু বলেন তাহলেই দুই হাত এক করে দিতে পারি।
কাকে আমি কি বলব?
মনসুরকে বলবেন।
আমি বললেই হবে?
অবশ্যই।
আচ্ছা দেখি।
তাতো দেখবেনই। আপনি না দেখলে কে দেখবে? আপনি হইলেন বটবৃক্ষ।
বটবৃক্ষ শব্দটা আমার সামনে দয়া করে আর উচ্চারণ করবেন না।
জি আচ্ছ- তবে সত্য কথা না বলেই বা কি করি? আজ আবার মঙ্গলবার। সত্য দিবস। বটবৃক্ষকে বটবৃক্ষ না বললে— মিথ্যাচার হয়।
সোবাহান সাহেব কঠিন চোখে তাকালেন। সেই দৃষ্টির সামনে এমদাদ চুপসে গেল। বটবৃক্ষ বিষয়টা নিয়ে আর আগানো ঠিক হবে না। তবে আজকাল মন্দ অগ্রসর হয়নি।
আড়ি পেতে কিছু শোনা
আড়ি পেতে কিছু শোনার মত মানসিকতা বিলুর নেই। তবু সে আড়ি পেতেছে।
একে আড়ি পাতা বলা বোধ হয় ঠিক হচ্ছে না। সে আনিসের ঘরের বাইরের দরজার পাশ ঘেঁসে দাঁড়িয়ে। ভেতরের কথা-বার্তা পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে। আনিস তার পুত্ৰ-কন্যার সঙ্গে গল্প করছে। এমন কিছু গল্প নয়, তবু শুনতে চমৎকার লাগছে। রাত প্ৰায় নয়টা। ওরা বাতি জ্বালায়নি। ঘর অন্ধকার করে গল্পের আসর। জমিয়েছে। বিলুর ইচ্ছা করছে। হঠাৎ ঘরে ঢুকে বলে, আমাকে দলে নিন আনিস সাহেব, আমিও গল্প শুনব। তা বলা সম্ভব নয়। সবাইকে অনেক বিধি-নিষেধ মেনে চলতে হয়। মনের অনেক ইচ্ছা মনে চেপে রাখতে হয়। বিলুদের যে টিচার ফিজিওলজি পড়ান বিলুর খুব ইচ্ছা করে কোন একদিন তাঁকে বলতে- স্যার, আপনার পড়ানোর ধরন আমার খুব ভাল লাগে। আমি এই জীবনে আপনার মত ভাল টিচার পাইনি, পাব বলেও মনে হয় না। এমন কিছু কথা না যা একজন সম্মানিত শিক্ষককে বলা যায় না। অবশ্যই বলা যায়। অবশ্যই বলা যায়। বিলু একদিন সেই কথাগুলো বলার জন্যে স্যারের ঘরে ভয়ে ভয়ে ঢুকতেই স্যার বাঘের মত গর্জন করে উঠলে— কি চাই? বিলু থতমত খেয়ে বলল, কিছু না স্যার। এইবার তিনি গর্জন করলেন সিংহের মত,- কিছু না, তাহলে বিরক্ত করছ, কেন? গেট আউট।
বিলু কেঁদে ফেলেছিল। কি অসম্ভব লজ্জা। গেট আউট বলে তাকে ঘর থেকে বের করে দেয়া। ছিঃ ছিঃ।
বিলুর মনে হচ্ছে আজ যদি সে আনিস সাহেবের ঘরে ঢুকে বলে আপনাদের মজার মজার গল্পে অংশ নিতে এসেছি তাহলে তিনি হয়ত শুকনো গলায় বলবেন, আপনি কিছু মনে করবেন না। এখন আমাদের পরিবারিক সেসন চলছে। বাইরের কেউ আসতে পারবে না। নিয়ম নেই। আবারো বিলুর চোখে পনি আসবে। ইনি অবশ্যি স্যারের মত গেট আউট বলবেন না। সবাই সব কিছু পারে না। ঐ স্যারটা ছিল পাগলা। ক্লাসের মধ্যে একবার একটি মেয়ে শব্দ করে হেসে উঠেছিল বলে তিনি চড় মারার ভঙ্গি করে মেয়েটির দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন। সেই মেয়ে ভয়ে অস্থির। ঠিক ঠক করে কাঁপছে। ভাগ্য ভালস্যার সেদিন নিজেকে সামলে নিলেন। চাপা গলায় বললেন, কামিজ পরিহিতা সুদৰ্শনা তরুণী! তোমার কি ধারণা আমি একজন গোপালভাড়? আমি তোমার সঙ্গে ভাঁড়ামি করছি? রিদার আর যেন হাসতে না দেখি। আরেকবার হাসলে সাড়শি দিয়ে টেনে তোমার উপরের পাটির একটা দাঁত তুলে ফেলব। উইদাউট এনেসথেসিয়া। এনেসথেসিয়া দেয়া হবে না।