বাবা মনু,
টাকা পাঠালাম। শরীরের যত্ন নেবে। তুমি ঢাকা শহরে কেন পড়ে আছ তা বুঝতে পারছি না। তোমার নিজের শহরে প্র্যাকটিস করতে অসুবিধা কি? একটা ভাল জায়গায় তোমার জন্য চেম্বার করে দেবার সামর্থ পরম করুণাময় আল্লাহতালা আমাকে দিয়েছেন পত্রপাঠ মন স্থির করে আমাকে জানাবে।
–ইতি তোমার আকবা।
পুনশ্চ ১ : আরো টাকার দরকার হলে লিখবে। এই নিয়ে সংকোচ করবে না। টাকা-পয়সা তোমাদের জন্যেই।
পুনশ্চ ২ : তোমার মার ইচ্ছা তোমার একটা বিবাহ দেন। ব্যাপারটা ভেবে দেখা। তোমার এখন পচিশ চলছে। আমি চব্বিশ বছর বয়সে তোমার মাকে বিবাহ করি। বিবাহের জন্যে এটাই উপযুক্ত বয়সী।
পুনশ্চ ৩ : তোমার নিজের কোন পছন্দ থাকলে আমাদের কোনই আপত্তি নাই, এটা তোমাকে বলে রাখলাম।
বাবার চিঠির সঙ্গে মার চিঠি থাকে। সেই চিঠিতে নানান অবান্তর কথার সঙ্গে একটি মেয়ের কথা থাকে। পুরো চিঠি জুড়ে থাকে সেই মেয়ের রূপ এবং গুণের বর্ণনা এবং সেই রূপবতী এবং গুণবতীর কয়েকটি রঙ্গীন ছবি।
গত সপ্তাহের চিঠিতে যে মেয়ের কথা ছিল তার নাম রূপা।
মনসুরের মা লিখেছেন—
বাবা মনু, এই মেয়েটির দিকে একবার তাকাইলে চোখ ফিরাইতে ইচ্ছা! করে না। বড়ই রূপবতী মেয়ে। আচার ব্যবহারেও চমৎকার। এই সবই হয়েছে বংশের গুণ। মেয়ের মাতুল বংশ খুবই উচ্চ। নান্দাইল রোডের সরদার পরিবার। এক ডাকে সবাই চিনে। মেয়ে মমিনুন্নেসা কলেজে বি এ ফাস্ট ইয়ারে পড়ে। মেট্রিক ফাস্ট ডিভিসন এবং জেনারেল অংকে লেটার পেয়েছিল। অসুখ নিয়ে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেয়ার ফল বেশি ভাল হয় নাই। মেয়ে খুব ভাল গান গায়। কলেজের সব ফাংশনে নজরুল গীতি গায় এবং খুব প্রশংসা পায়। মেয়ের তিনটি ছবি পাঠালাম। তোমার পছন্দ হলে আরো কথাবার্তা বলব।
চিঠির সঙ্গে খুব সেজেগুজে তোলা তিনটা ছবি। একটা ছবিতে সে টেলিফোন তুলে কার সঙ্গে কথা বলছে। একটায় অবাক বিস্ময়ে পৃথিবীর দিকে অর্থাৎ ক্যামেরার লেন্সের দিকে তাকিয়ে আছে। অন্য ছবিটা ফুলের বাগানে তোলা। আউট অব ফোকাস হওয়ায় মেয়েটাকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না, ফুলগুলো বড় সুন্দর এসেছে।
এসব চিঠি এবং চিঠির সঙ্গে ছবি পেতে মনসুরের মন্দ লাগে না। ভালই লাগে। কোন এক লজাবনত তরুণীর সঙ্গে তার বিয়ে হচ্ছে এই কল্পনাও তার কাছে মধুর বলে মনে হয়।
গ্ৰীন ফার্মেসীর জীবন এবং তার সঙ্গে মধুর কিছু কল্পনায় তার সময় ভােলই কাটছিল। একটা মেয়ে হঠাৎ করে এসে সব এলোমেলো করে দিল। ঐ মেয়েটার কারণে কদিন ধরেই মনসুরের মনে হচ্ছে–মানব জীবন একটা যন্ত্রণা বিশেষ। তার রাত্রে ভাল ঘুম হচ্ছে না। হজমের অসুবিধা হচ্ছে। ঘটনাটা এ রকম
গত বুধবারে খুব মেঘলা ছিল। দুপুরে টিপটপ করে বৃষ্টি শুরু হল। কুদ্দুস সাহেব ভাত খেতে গেছেন। দোকানের এক কর্মচারী মজনু বলল, স্যার আপনি একটু বসেন আমি লাস্ত্রী থেকে কাপড় নিয়ে আসি। মনসুর বলল, যাও আমি আছি। মজনু চলে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটি মেয়ে এসে ঢুকল। পরণে সাধারণ নীল রঙের একটা শাড়ি। মাথার চুল খোপা করা। খোপা ভাল করে করা হয়নি–চুল এলোমেলো হয়ে আছে। মেয়েটির দিকে তাকিয়েই মনসুরের কেমন যেন লাগতে লাগল। এমন সুন্দর মানুষ এই পৃথিবীতে আছে? ছেলেবেলার রূপকথার বইয়ে যেসব বন্দিনী রাজকন্যার ছবি থাকে এই মেয়ে তার চেয়েও লক্ষ গুণ সুন্দর। কেমন মায়া মায়া চোখ, সমস্ত চেহারায় কি অদ্ভুত একটা স্নিগ্ধ ভাব। মেয়েটা এত সুন্দর যে তার দিকে তাকাতে পর্যন্ত মনসুরের কষ্ট হচ্ছে।
মেয়েটা নরম স্বরে বলল, আপনাদের কাছে স্যাভলনি বা ডেটল জাতীয় কিছু আছে?
মনসুর কাঁপা গলায় বলল, জ্বি আছে।
মাঝারি সাইজের একটা ফাইল দিন।
এক্ষুণি দিচ্ছি। আপনি বসুন। ঐ চেয়ারটায় বসুন।
মেয়েটি বিস্মিত গলায় বলল, বসতে হবে কেন? জিনিসটা দিন চলে যাই। দাম কত?
মনসুর কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, দাম লাগবে না।
মেয়েটি আরো অবাক হয়ে বলল, দাম লাগবে না কেন?
না মানে কোম্পানি থেকে আমরা অনেক স্যাম্পল ফাইল পাইতো–এটা হচ্ছে একটা স্যাম্পল ফাইল।
মেয়েটি বিরক্ত গলায় বলল, স্যাম্পল ফাইল আমাকে দেবার দরকার নেই। অন্য কাউকে দেবেন। দাম কত বলুন?
দামতো আমি জানি না।
দাম জানেন না মেন?
আমাদের কর্মচারি লন্ড্রীতে গেছে। ও সব জানে। এক্ষুণি এসে পড়বে।
আপনি তাহলে কে?
আমি ডাক্তার। মানে এই ফার্মেসীতে বসি। সকাল বিকাল দুবেলাই থাকি। আপনি ঐ চেয়ারটায় বসুন।
বসতে পারব না। আমার তাড়া আছে। আমার মা বটিতে হাত কেটে ফেলেছেন। হাতে ডেটল দিতে হবে।
মনসুর অসম্ভব ব্যস্ত হয়ে বলল, চলুন যাই ড্রেস করে দিয়ে আসি। কাটা ছেড়া ছোট হলেও একে অবহেলা করা ঠিক না। সেপটিকে হয়ে যেতে পারে।
মেয়েটি খুবই অবাক হল। কেমন যেন অদ্ভুত চোখে তাকাতে লাগল। শান্ত গলায় বলল, মার হাতের কাটা এমন কিছু না।
মজনু এই সময় ফিরে এল। মেয়েটা টাকা দিয়ে স্যাভলনের শিশি হাতে নিয়ে চলে গেল। মনসুরের সারাটা দিন আর কোন কাজে মন বসল না। আশ্চর্যের ব্যাপার সেই রাতে সে ঘুমাতে পারল না। একটা মেয়েকে একবার দেখে কারোর এমন হয়?
দ্বিতীয় দিনে মেয়েটির সঙ্গে আবার দেখা। বই খাতা নিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছিল। ভাগ্যিস ঠিক সেই সময়ে মনসুর বের হয়েছিল সিগারেট কিনতে। মনসুর জীবনে যা কোনদিন করেনি। তাই করল, এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনার মা ভাল আছেন?