সোবাহান সাহেবের মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল, একুশ বছর বয়েসী। একটা মেয়ে যদি কথায় কথায় কেঁদে ফেলে তাহলে বুঝতে হবে দেশের নারী সমাজের চরম দুদিন যাচ্ছে।
কথা বলছি না কেন, কিছু বলেছ মিলিকে? মেয়ে বড় হয়েছে এখন যদি রাগারগি কর।
সোবাহান সাহেব শীতল গলায় বললেন, মিনু তোমাকে এখন একটা কঠিন কথা বলব, মন দিয়ে শোন— আমি তোমাদের সংসারে আর থাকব না।
তার মানে, কোথায় যাবে তুমি?
সেটা এখনো ঠিক করিনি। আজ দিনের মধ্যে ঠিক করব।
মিনু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। সোবাহান সাহেব বললেন, একটা অপ্রিয় ডিসিসান নিলাম। বাধ্য হয়েই নিলাম।
বনে জঙ্গলে গিয়ে সাধু সন্ন্যাসী হবে?
এই বিষয়ে তোমার সঙ্গে কোন কথা বলতে চাই না।
সোবাহান সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। মিনু বললেন, যাচ্ছ কোথায়?
তিনি এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। অতি দ্রুত গেট খুলে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালেন। তার বাড়ির সামনের রাস্তার ওপাশেই এখন একটা মাইক ভাড়ার দোকান হয়েছে। সারাক্ষণ সেখানে থেকে হ্যালো মাইক্রোফোন টেস্টিং ওয়ান-টু–খ্ৰী। হ্যালো মাইক্রোফোন টেস্টিং ওয়ান-টু–গ্ৰী হয়। এখন হচ্ছে না। এখন তারা একটা রেকর্ড বাজাচ্ছে হাওয়া সে উড়তা যারে মেরা লাল দু পাট্টা মলমল। এই লক্ষ কোটি বার শোনা গান শুনে মেজাজ আরো খারাপ হবার কথা, তা হল না। সোবাহান সাহেব লক্ষ্য করলেন–গানটা শুনতে তাঁর ভাল লাগছে। তিনি এর কারণ বুঝতে পারলেন না। তিনি আকাশের দিকে তাকালেন, আকাশ ঘন নীল, নীল আকাশে সাদা মেঘের স্তূপ। আকাশ এবং মেঘ দেখতেও তার ভাল লাগল। তাঁর মনে হল— মানব জীবন বড়ই মধুর। এই জীবনের আনন্দ হেলা ফেলার বিষয় নয়।
মানব জীবন বড়ই মধুর
নব জীবন বড়ই মধুর এই কথা সবার জন্যে সম্ভবত প্ৰযোজ্য নয়। গ্ৰীন ফার্মেসীর নতুন ডাক্তার মনসুর আহমেদের জন্যে তো অবশ্যই নয়। তার কাছে মনে হচ্ছে–মানব জীবন অর্থহীন যন্ত্রণা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই রকম মনে করার আপাত দৃষ্টিতে তেমন কোন কারণ নেই। সে মাত্র ছয়মাস আগেই ইন্টার্নশীপ শেষ করে বের হয়েছে। এর মধ্যেই ভোলা উপজেলায় স্বাস্থ্যু কমপ্লেক্সে একটা চাকরিও পেয়েছে। ঢাকা ছেড়ে যাবার ইচ্ছা নেই বলে ঐ চাকরি সে নেয়নি। আপাতত সে গ্রীন ফার্মেসীতে বসছে। গ্রীন ফার্মেসীর মালিক কুদ্দুস সাহেব তাকে ফার্মেসীর উপরে দুটি ঘর ছেড়ে দিয়েছেন। মনসুর ঐ ঘর দুটিতে সংসার পেতে বসেছে। প্রতিদিন কিছু রুগী টুগীও পাচ্ছে। বড় কিছু নাসর্দি জ্বর, কাশি, ডায়রিয়া। একদিন অল্পবয়সী একটা মেয়েকে নিয়ে মেয়ের মা এসেছিলেন, চেংড়া ডাক্তার দেখে মেয়ের অসুখ প্রসঙ্গে কিছু বললেন না। গম্ভীর গলায় বললেন, না থাক আপনাকে দেখতে হবে না। আমার দরকার একজন বয়স্ক ডাক্তার। আপনি তো নিতান্তই বাচ্চা ছেলে।
কুদ্দুস সাহেব বললেন, ডাক্তারদের কোন বয়স নেই। আপা। ডাক্তার হচ্ছে ডাক্তার। আর এর বয়স কম হলে কি হবে জাত-সাপ।
জাত সাপের প্রতি রুগী বা রুগীনির মা কারোরই কোন আগ্রহ দেখা গেল না। রুগীনি বলল, আমি উনাকে কিছু বলব না মা।
এ রকম দু একটা কেইস বাদ দিলে রুগী যে খুব খারাপ হচ্ছে তাও না। ভিজিটের টাকা চাইতে মনসুরের লজ্জা করে। ঐ দায়িত্ব কুদ্দুস সাহেব খুব ভাল ভাবেই পালন করছেন।
দশ টাকা কি দিচ্ছেন ভাই? উনার ভিজিক কুড়ি টাকা। বয়স কম বলে অশ্রদ্ধা করবেন না–গোল্ড মেডালিস্ট।
মনসুর বিব্রত গলায় বলেছে, কুদ্দুস ভাই, সব সময় গোল্ড মেডেলের কথা বলেন। কোন মেডেল ফেডেল তো আমি পাই নি।
কুদ্দুস সাহেব নির্বিকার ভঙ্গিতে বলেছেন, পাওয়ার দরকার নেই। মানুষের মুখেই জয়। মানুষের মুখেই ক্ষয়। মুখে মুখে মেডেলের কথাটা রটে যাক। সুটকেস খুলে কেউতো আর মেডেল দেখতে আসবে না।
এসব মিথ্যা কথা বলে। লাভ কি?
নাম ফাটবেরে ভাই নাম ফাটবে। তোমার নাম ফাটা মানে ফার্মেসীর উন্নতি। ফার্মেসীর উপর বেঁচে আছি। ফর্মেসীর উন্নতি দেখতে হবে না?
কুদ্দুস সাহেবের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। তিনি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ফার্মেসীতে বসে থাকেন। সারাক্ষণ কথা বলেন। মানুষটাকে মনসুরের বেশ ভাল লাগে। তাঁর বকবকানি এবং উপদেশ শুনতেও মনসুরের খারাপ লাগে না।
তোমার সবই ভাল বুঝলে ডাক্তার, তবে তোমার একটা বড় সমস্যা কি জান? তোমার কোন উচ্চাশা নেই।
সেটা সমস্যা হবে কেন?
এইটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা। দু ধরনের মানুষের উচ্চাশা থাকে না, মহাপুরুষদের এবং বেকুবদের। তুমি এই দুদলের কোন দলে সেটা বুঝতে পারছি না। সম্ভবত দ্বিতীয় দলে।
আমাকে নিয়ে ভাবার দরকার নেই।
দরকার থাকবে না কেন, অবশ্যই আছে। এ রকম ইয়াং একজন ছেলেগোল্ড মেডালিস্ট, অথচ তার কোন উচ্চাশা নেই—
কি মুশকিল গোল্ড মেডেলের কথা আবার বলছেন?
ঐ একই হল। পেতেও তো পারতে। আমি যা বলছি তার সারমর্ম হচ্ছেসুযোগ খুঁজতে হবে। বিলেত আমেরিকা যেতে হবে, এফ আর সি এস, এম আর সি পি হয়ে এসে রুগীদের গলা কেটে পয়সা করতে হবে। আলিশান দালান তুলতে হবে—
আমার এত সব দরকার নেই। আমি সুখেই আছি।
সুখে আছ?
হ্যাঁ সুখে।
মনসুর আসলেই সুখে আছে। তার উপর সংসারের দায়-দায়িত্ব কিছু নেই। তার বাবা ময়মনসিংহ শহরে ওকালতি করেন। দেশের বাড়ির অবস্থা মন্দ নয়। ময়মনসিংহের এত বড় বাড়িতে মানুষ বলতে বাবা-মা এবং ছোট বোন নীলিমা। মনসুরকে টাকা রোজগার করে সংসার চালানোর দায়িত্ব নিতে হচ্ছে না। উল্টা প্রতিমাসে মনসুরের বাবা এক হাজার করে টাকা পাঠিয়ে ছোট একটি চিঠি লিখেন। প্রতিটি চিঠির ভাষা এবং বক্তব্য এক।