- বইয়ের নামঃ বহুব্রীহি
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ আফসার বাদ্রার্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
বিশাল দোতলা বাড়ি
চু দেয়ালে ঘেরা পুরানো ধরনের বিশাল দোতলা বাড়ি। বাড়ির সামনে এবং পেছনে গাছগাছলিতে জঙ্গলের মত হয়ে আছে। কিছু কিছু গাছের গুড়ি কালো সিমেন্টে বাধানো। বাড়ির নাম নিরিবিলি, শ্বেত পাথরে গেটের উপর নাম লেখা, অবশ্যি র এর ফোঁটা মুছে গেছে। পাড়ার কোন দুষ্ট ছেলে হারিয়ে যাওয়া ফোঁটাটা বসিয়ে দিয়েছে ব এর উপর। এখন বাড়ির নাম নিবিরিলি।
সাধারণত যেসব বাড়ির নাম নিরিবিলি হয়, সেসব বাড়িতে সারাক্ষণই হৈ চৈ হতে থাকে। এই মুহুর্তে এ বাড়িতে অবশ্যি কোন হৈ চৈ হচ্ছে না। বাড়ির প্ৰধান ব্যক্তি সোবাহান সাহেবকে বারান্দার ইজি চেয়ারের পা মেলে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে। তাঁর মুখ চিন্তাক্লিষ্ট। চোখে সুস্পষ্ট বিরক্তি।
সোবাহান সাহেব বছর দুই হল ওকালতি থেকে অবসর নিয়েছেন। কর্মহীন জীবনে এখনো অভ্যস্ত হতে পারেন নি। দিনের শুরুতেই তার মনে হয়। সারাটা দিন কিছুই করার নেই। তাঁর মেজাজ সেই কারণ ভোরবেলায় খুবই খারাপ থাকে। আজ অন্য দিনের চেয়েও বেশি খারাপ, কেন তা তিনি বুঝতে পারছেন না। শরৎকালের একটা চমৎকার সকাল। ঝকঝকে রোদ, বাতাসে শিউলি ফুলের গন্ধ। এ রকম একটা সকালে মন খারাপ থাকার প্রশ্নই আসে না।
সোবাহান সাহেবের গায়ে হলুদ রঙের একটা সুতির চাদর। গলায় বেগুনি রঙের মাফলার। আবহাওয়া বেশ গরম, তবু তিনি কেন যে মাফলার জড়িয়ে আছেন তা বোঝা যাচ্ছে না। তার হাতে একটা পেপার ব্যাক, ডিটেকটিভ গল্প। কাল রাতে বত্ৰিশ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পড়েছিলেন। গত একটা ঘণ্টা ধরে তেত্রিশ নম্বর পৃষ্ঠা পড়তে চেষ্টা করছেন, পারছেন না। বার বার ইচ্ছে করছে বই ছিড়ে কুটি কুটি করে ফেলে হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলতে। তেত্রিশ পৃষ্ঠায় নেইল কাটার দিয়ে খুঁচিয়ে মীথ নামে একটি লোকের বা চোখ তুলে নেবার বিষদ বর্ণনা আছে। সোবাহান সাহেব অবাক হয়ে পড়লেন— চোখ উপড়ে তুলে নেবার সময়ও মিঃ স্মীথ রসিকতা করছে এবং গুন গুন করে গাইছে–লন্ডন ব্রীজ ইজ ফলিং ডাউন।
কোন মানে হয়? যে লেখক এই বইটি লিখেছে সোবাহান সাহেবের ইচ্ছে করছে তার বা চোখটা নেইল কাটার দিয়ে তুলে ফেলতে।
সোবাহান সাহেবের ছোট মেয়ে মিলি চায়ের কাপ নিয়ে বারান্দায় ঢুকল। বাবার সামনের গোল টেবিলে কাপ নামিয়ে রাখতে রাখতে হাসিমুখে বলল, বাবা তোমার চা।
সোবাহান সাহেব থমথমে গলায় বললেন, কিসের চা?
চা পাতায় তৈরি চা, আবার কিসের?
এখন কেন?
তুমি সকাল আটটায় এক কাপ চা খাও এই জন্যে এখন। সকাল আটটা কিছুক্ষণ আগে বাজল?
সোবাহান সাহেব থমথমে গলায় বললেন, পিরিচে চা পড়ে আছে কেন? চা থাকবে চায়ের কাপে!
তাই আছে বাবা, পিরিচে এক ফোঁটা চা নেই। তুমি ভাল করে তাকিয়ে লেখ।
তিনি চায়ের কাপ হাতে নিলেন। মনে মনে ঠিক করলেন চা অতিরিক্ত মিষ্টি হলে বা মিষ্টি কম হলে মেয়েকে প্ৰচণ্ড ধমক দেবেন। কাউকে ধমকাতে ইচ্ছা! করছে। তিনি অত্যন্ত মনমরা হয়ে লক্ষ্য করলেন, চা-য়ে চিনি ঠিকই আছে। চা আনতে আনতে ঠাণ্ডাও হয় নি, যতটুকু গরম থাকার কথা ততটুকুই আছে, বেশিও না কমও না।
মিলি বলল, সব ঠিক আছে। বাবা?
তিনি জবাব দিলেন না। মিলি হালকা গলায় বলল, ভোরবেলা তোমার জন্যে চা আনতে যা ভয় লাগে। একটা না একটা খুঁত ধরে বিশ্ৰী করে বিকা দাও। বাবা, তোমার পাশে খানিকক্ষণ বসব?
সোবাহন সাহেব এই প্রশ্নেরও জবাব দিলেন না। মিলি, গোল-টেবিলের এক কোণায় বসল। তার বয়স একুশ। একুশ বছরের একটা আলাদা সৌন্দৰ্য আছে। সেই সৌন্দর্যে সে ঝলমল করছে। তার পরনে কমলা রঙের শাড়ি। শরৎকালের ভোরের সঙ্গে এই শাড়িটি চমৎকার মানিয়ে গেছে। মিলি হাসিমুখে বলল, এই গরমে গলায় মাফলার জড়িয়ে আছ কেন বাবা? দাও খুলে দেই।
সোবাহান সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, খোলার প্রয়োজন মনে করলে নিজেই খুলতাম। মাফলার খোলা খুব জটিল কোন বিষয় নয় যে দ্বিতীয় ব্যক্তির সাহায্য লাগবে।
মিলি হেসে ফেলল। হেসেই চট করে মুখ ঘুরিয়ে নিল, বাবা তার হাসি দেখতে গেলে রেগে যেতে পারেন। মিলি মুখের হাসি মুছে বাবার দিকে তাকাল। হাসি অবশ্যি পুরোপুরি গেল না— তার চোখে ঝিলমিল করতে লাগল। বাবা, রোজ ভোরে তুমি একটা ঝগড়া বাধাতে চাও কেন বলতো? ভোরবেলা তোমার ভয়ে আমি অস্থির হয়ে থাকি।
এই বলে মিলি আবার হেসে ফেলল। এখন তার হাসি দেখে মনে হল না। বাবার ভয়ে সে অস্থির। সোবাহান সাহেব কিছুই বললেন না। বই খুললেন, তেত্রিশ পৃষ্ঠাটা পড়ার একটা শেষ চেষ্টা করা যাক।
মিলি বলল, তুমি মোর্ডার ইন দা ডার্ক পড়ছ? অসাধারণ একটা বই–তাই না বাবা?
সোবাহান সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, অসাধারণ?
হ্যাঁ অসাধারণ, স্মীথ নামের একটা লোকের বা চোখ নেইল কাটার দিয়ে খুঁচিয়ে তুলে ফেলা হয়…
এটা অসাধারণ? লোকটার সাহস তুমি দেখবে না? লোকটা তখন গান গাইতে থাকেলন্ডন বীজ ইজ ফলিং ডাউন, ফলিং ডাউন….। তারপর কি হয় জান? এই অবস্থায় সে কোক করে একটা লাথি বসায় মাডারারটার পেটে। মার্ডারার এক মুহুর্তের জন্যে অন্যমনস্ক হতেই সে উপড়ে তোলা চোখটা ছিনিয়ে তিনতলার জানোলা দিয়ে নিচে লাফ দেয়। তার চোখ দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে। তীব্ৰ ব্যথায় সে দিশাহারা, তবু সে ছুটে যায় একটা হাসপাতালে, ডাক্তারকে হাসি মুখে বলে–ডাক্তার সাহেব। আপনি কি এই চোখটা জায়গামত বসিয়ে দিতে পারেন? যদি পারেন তাহলে আপনাকে আমি লন্ডন শহরের সবচেয়ে বড় গোলাপটি উপহার দেব। সৌভাগ্য ক্রমে সেই হাসপাতালে তখন ছিলেন ইউরোপের সবচেয়ে বড় আই সার্জন ডঃ এসিল নায়ার। তিনি— সোবাহান সাহেব থমথমে গলায় বললেন, সে লোকটার চোখ লাগিয়ে দিল?