কি সুন্দর! কি সুন্দর! আর তাঁর সিংহাসনটাই কত সুন্দর! সিংহাসনের নিচটাও লাল উপরের দিকটা শাদা। অবিকল প্রাসাদের মত।
রাণী-মা’র সঙ্গে দেখা হবার পর তাঁকে যেসব কথা বলতে হয় তার কিছুই এখন পিপলী বেগমের মনে নেই। সব ভুলে গেছে। সে কয়েকবার বলল, হে মহান! হে মহান! হে মহান! … বাকি কথাগুলি আর মনে পড়ল না। রাণী-মা হাসলেন। চাপা হাসি। তারপর নরম গলায় বললেন —
কেমন আছ পিপলী বেগম?
পিপলী বেগমের গলায় কথা আটাকে যাচ্ছে। সে তোতলাতে তোতলাতে বলল, ভা ভা ভা ভাল আছি রাণী মা। সে আবার কথাগুলি বলার চেষ্টা করল, হে মহান হে মহান করল কিন্তু লাভ হল না। কিছুই মনে পড়ছে না।
রাণী-মা বললেন, তুমি নিশ্চয়ই ক্ষুধার্ত?
পিপলী মাথা নাড়ল। সে ক্ষুধার্ত। অসম্ভব ক্ষুধার্ত। রাণীমা নিজ থেকে বলার আগে তা সে নিজেই বুঝতে পারে নি। রাণী-মা বললেন –পিপলীকে খেতে দাও।
দুটি পিপড়া থালায় করে খাবার আনছে। কিন্তু তারা এমন অদ্ভুতভাবে হাঁটছে কেন? এলোমেলোভাবে পা ফেলছে। শুধুমাত্র অন্ধরাই এমনভাবে হাঁটে। আচ্ছা, এরা কি অন্ধ?
দুটি পিপড়া যন্ত্রের মত এক সঙ্গে বলল, তোমার জন্যে খাবার এনেছি। খেয়ে নাও।
পিপলী কৌতূহল সামলাতে না পেরে বলল, আচ্ছা, আপনারা কি অন্ধ?
তোমার এত কথার দরকার কি? খাবার এনেছি, খাও।
আপনাদের ধন্যবাদ।
আমাদের ধন্যবাদ দেয়ার দরকার নেই। রাণী-মাকে ধন্যবাদ দাও।
রাণী-মাকে ধন্যবাদ।
থালাভর্তি তরল সোনার মত খাবার।
ঝিকমিক করছে। কি তার গন্ধ! চারদিক মোহিত হয়ে যাচ্ছে। পিপলী একটু মুখে দিল –এত মিষ্টি! এত স্বাদ! ইশ, সে যদি তার মাকে আর দাদীমাকে একটু খাওয়াতে পারত! খানিকটা খাবার কি সে তাদের জন্যে নিয়ে যাবে? নিয়ে গেলে কি অসভ্যতা হবে? রাণীমা রাগ করবেন?
যারা খাবার এনেছে তাদের একজন ফিসফিস করে বলল, গবগব করে খেও না। রাণী-মা’র সামনে গব গব করে খাওয়া অসভ্যতা। পিপলী বলল, এই খাবারটার নাম কি?
নাম দিয়ে তুমি কি করবে? এই খাবার কি আর খেতে পারবে? আর পারবে না। এ হচ্ছে রাণী-মা’র খাবার। নিশি ফুলের মধু। নাম শুনেছ কখনো?
না।
দেখ, তোমার কত ভাগ্য, যে খাবারের নামও কখনো শুননি সেই খাবার খেতে পাচ্ছ। চেটেপুটে খাও। ফেলে রেখো না।
পিপলী চেটেপুটে খেল। তার ইচ্ছা করছে যে থালায় করে খাবার এনেছে সেই থালাটাও খেয়ে ফেলতে। এতই মজার খাবার!
রাণী-মা বললেন, পিপলী বেগম।
জি রাণী মা!
আমি শুনেছি তোমার পড়াশোনা করতে ভাল লাগে না। এটা কি সত্যি পিপলী?
সত্যি নয়, রাণী-মা।
তাহলে তুমি মিথ্যা কথা বলেছ তোমার বড় আপার কাছে?
জি রাণী-মা।
তুমি অপরাধ করেছ পিপলী বেগম। শাস্তি পাবার মত অপরাধ।
জি রাণী-মা।
কিন্তু তুমি অঙ্কে উনিশ পেয়েছ। ভূগোলে মাত্র তেইশ। তুমি কি অঙ্ক এবং ভূগোল ঠিকমত পড়নি?
ঠিকমতই পড়েছি।
তাহলে পরীক্ষা খারাপ হল কেন?
ইচ্ছা করে পরীক্ষা খারাপ দিয়েছি। জানা অঙ্ক ভুল করেছি।
কেন?
কারণ আমি জানি পরীক্ষা খারাপ করলে আপনি ডেকে পাঠাবেন। এর আগে একজন পরীক্ষা খারাপ করেছিল –আপনি ডেকে পাঠিয়েছিলেন। আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছিলাম।
কি কথা বলতে চাও?
আমি কি আপনার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারি রাণী-মা?
পার।
পিপলী রাণী-মা’র দিকে তাকাল। রাণী-মাও এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছেন, কিন্তু তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে না তিনি খুব রাগ করছেন। বরং মনে হচ্ছে। তিনি মজা পাচ্ছেন।
পিপলী বেগম!
জি রাণী-মা।
বল, কি বলতে চাও।
পিপলী কি বলবে গুছিয়ে নিল। যদিও রাণী-মাকে এখন আর ভয় ভয় করছে না, তবু তার কাছে সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো লাগছে। মাথা ঝিমঝিম করছে। শরীর হালকা লাগছে। একটু যেন ফুর্তি-ফুর্তি ভাবও হচ্ছে। এরকম হচ্ছে কেন? খাবারটার জন্যে হচ্ছে?
রাণী-মা বললেন, চুপ করে আছ কেন? শুরু কর। আমি তোমার কথা শোনার জন্যে অপেক্ষা করছি।
রাণী-মা, আপনার সঙ্গে দেখা হলে যে কথাটা বলতে হয় সেই কথাটা আমি ভুলে গিয়েছিলাম। এখন মনে পড়েছে –হে পিপীলিকা সম্প্রদায়ের মহান রাণী, আপনার মঙ্গল হোক! কল্যাণ হোক!
রাণী-মা বললেন, তোমারও মঙ্গল হোক। কল্যাণ হোক।
রাণী-মা এখন আমি বলি –কি জন্যে এসেছি।
বল।
বলার আগে আমার খুব নাচতে ইচ্ছা করছে। রাণী-মা, আমি কি একটু নাচতে পারি? বেশি নাচব না। অল্প একটু নাচব।
বেশ তো নাচ। আমি অনেকদিন নাচ দেখি না।
পিপলী বেগম ঘুরে ঘুরে খানিকক্ষণ নাচল –গুন গুন করে নাচের সঙ্গে গানও গাইল —
নাচে পিপলী নাচে রে
ধিন ধিনাধিন নাচে রে
ঘুরে ফিরে নাচে রে
শুড় ঘুরিয়ে নাচে রে।
পা কাঁপিয়ে নাচে রে
নাচে পিপলী নাচে রে।
নাচতে পিপলীর ভাল লাগে
নাচতে পিপলীর সব সময়ই ভাল লাগে। আজ যেন আরো ভাল লাগল। মনে হল সারাদিন সে শুধু নেচেই যাবে। নেচেই যাবে।
তোমার নাচ কি শেষ হয়েছে, পিপলী?
জি, রাণী-মা।
এখন বল কি বলতে এসেছ?
আপনাকে আমি পছন্দ করি না, রাণী-মা?
আমাকে তুমি পছন্দ কর না?
না।
শুনে দুঃখিত হলাম। আমার উপর কি তোমার প্রচণ্ড রাগ আছে?
আছে।
তোমার কি ইচ্ছা করছে আমাকে মেরে ফেলতে?
হ্যাঁ, ইচ্ছা করছে।
বল কেন ইচ্ছা করছে।
পিপলী নেচে-নেচে খানিকটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। আবার কথা বলা শুরু করার আগে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নিল —