কি ব্যাপার চাচা?
বলছি। একটু সামাল দিয়ে নি। এক সঙ্গে সব ঝামেলা মাথায় এসে পড়ে। শ্রমিক পিপড়াদের বার্তা আগে শেষ করি। বলতে বলতে গলাও গেছে ভেঙ্গে।
আপনাকে এই বার্তা আর কষ্ট করে বলতে হবে না চাচা। সবাই এর মধ্যে শুনে ফেলেছে।
তা ঠিক সবাই শুনেছে।
আচ্ছা চাচা রাণী-মা সৈন্য না পাঠিয়ে এদের পাঠাচ্ছেন কেন?
আমি তো ঠিক জানি না মা। রাণী-মা কে আমিতো আর প্রশ্ন করতে পারি না। তবে আমার মনে হয় তিনি প্রথম শ্রমিক পিপড়া পাঠাচ্ছেন যাতে ওরা মনে করে আমাদের কোন সৈন্য নেই। সৈন্য শেষ হয়ে গেছে। এই ভেবে যখন তারা অসতর্ক হয়ে পড়বে তখন হয়ত আমাদের আসল সৈন্যরা যাবে।
কিন্তু তার আগেইতো আমাদের এরা সবাই মারা যাবে।
মেয়র দুঃখিত গলায় বললেন, তা ঠিক মা। তা ঠিক।
পিপলী বলল, আমার সঙ্গে আপনার কি জরুরী কথা চাচা?
খুবই জরুরী কথা মা। খুবই জরুরী কথা। রাণী-মা তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। আমার কাছে পাস পাঠিয়ে দিয়েছেন। পাস নিয়ে বাসায় চলে যাও।
পিপলী হকচকিয়ে গেল। নরম গলায় বলল, কখন যেতে হবে চাচা?
সব পাসের উপর লেখা আছে। আগামী কাল। মা এখন আমার সমানে থেকে যাও —বড়ই ব্যস্ত —
শ্রমিক পিপীলিকার জন্যে
রাণী মা’র জরুরী বার্তা .
পিপলী বাড়ি ফিরে দেখে তার মা খুবই উত্তেজিত। তিনি ছোটাছুটি করছেন। উত্তেজনার জন্যে ঠিকমত কথাও বলতে পারছেন না।
কথা জড়িয়ে যাচ্ছে –
ও পিপলী, তোকে রাণী-মা ডেকে পাঠালেন কেন?
জানি না মা।
কি আশ্চর্য কথা! এই দেখ, আমার হাত-পা কাঁপছে। রাণী-মা ডেকে পাঠিয়েছেন –সহজ কথা তো না। তের ভয় লাগছে না পিপলী?
একটু লাগছে?
লাগারই কথা। তবে ভয়ের কিছু নেই। রাণী-মা খুব দয়ালু। রাণী-মা’র সঙ্গে দেখা হলে কি বলতে হবে জানিস তো? প্রথমেই বলতে হবে –হে পিপড়া সম্প্রদায়ের মহান রাণী! আপনার মঙ্গল হোক, কল্যাণ হোক! আর কথা বলার সময় রাণী-মা’র চোখে চোখে কখনো তাকাবি না। কথা বলার সময় রাণী-মা’র চোখের দিকে তাকানো খুব অসভ্যতা। রাণী-মা’র সঙ্গে খুব জোরেও কথা বলা যাবে না, আবার ফিসফিস করেও কথা বলা যাবে না। দুটোই অসভ্যতা।
আমি জানি মা।
আজ রাতে তোকে উপোষ থাকতে হবে।
কেন?
রাণী-মা’র কাছে ভরা পেটে যেতে নেই। রাণী-মা’র কাছে ভরা পেটে যাওয়াও অসভ্যতা।
রাতে উত্তেজনায় পিপলী বেগম, পিপলী বেগমের মা এবং দাদীমা কেউই ঘুমুতে পারল না। তিনজন একসঙ্গে বসে গল্প করে করেই রাত কাটিয়ে দিল। এত বড় একটা যুদ্ধ হচ্ছে তা যেন কারোর মনেও নেই। পিপলীর দাদীমা বললেন, আমার কাছ থেকে একটা ছড়া ভালমত শিখে যা পিপলী। ছড়া শিখে গেলে রাণী-মাকে শুনাতে পারবি। রাণী-মা খুশি হবেন।
রাগও হতে পারেন। তোমার ছড়াগুলি যা পচা পচা।
এই ছড়াটা সুন্দর। আর তুই যদি গানের মত করে বলিস তাহলে শুনতে ভাল লাগবে। ইচ্ছা করলে নেচে নেচেও শুনাতে পারিস। তবে নেচে নেচে শুনানো অসভ্যতা কিনা তাও জানি না। ছড়াটা বল।
রাণী-মা, রাণী-মা
গালে তার লালিমা …
পিপলী দাদীমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, রাণী-মা’র গালে লালিমা কি-না তা তো কেউ জানে না। কেউ তো রাণী-মাকে দেখেনি …
আচ্ছা, তাই তো। তাহলে তুই কি একটা মশার ছড়া শুনাবি?
মশার ছড়া? মশার ছড়া শুনে উনি কি করবেন?
হয়ত উনার ভাল লাগবে —
মশা মশা মশা
চুপচাপ বসা
কাছে গেলে
উড়ে যায়
দূরে যায়
দিন রাত
গান গায়।
ফুল খায়
ফল খায়
মানুষের রক্ত খায়।
মশা মশা মশা
চুপ চাপ বসা।
পিপলী, ছড়াটা কেমন লাগল রে?
ভাল লাগেনি। আর ছড়া-টড়া বলার দরকার নেই। এসো দাদীমা, আমরা চুপচাপ বসে রাত পার করে দিই। আমার ভাল লাগছে না।
ভাল লাগছে না কেন?
আমার শুধু মনে হচ্ছে রাণী-মা হয়তো আমার উপর বিরক্ত হবেন। আমাকে শাস্তি দেবেন।
ওমা, এ কেমন কথা! তোর উপর বিরক্ত হবেন কেন?
তা জানি না। কিন্তু মনে হচ্ছে বিরক্ত হবেন।
অলুক্ষণে কথা বলিস না তো।
.
খুব ভোরে পিপলী বেগমের মা পিপলীকে সাবান মাখিয়ে গোসল করিয়ে আনলেন। পিপলীর চোখ এম্নিতেই সুন্দর, তারপরেও চোখের দুপাশে কাজল লাগিয়ে দিলেন। পিপলীকে সুন্দর দেখাতে লাগল। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তোর বাবা থাকলে আজ কত খুশি হত! আনন্দে হয়ত চিৎকার করে কাঁদত –তার মেয়ে যাচ্ছে রাণী-মা’র সঙ্গে দেখা করতে –সহজ কথাতো না। কত বড় কথা! কত আনন্দের কথা! আহা, মানুষটা আজ কোথায় না জানি আছে।
দাদীমা বললেন, ভয় লাগছে না-কি রে পিপলী?
পিপলী বলল, না। তার কিন্তু ভয় লাগছে। বেশ ভয় লাগছে।
.
সূর্য আকাশে অনেকখানি উঠেছে। পিপলী বেগম রওনা হয়েছে রাণী-মা’র কাছে। পিপলীর মা ঘরে বসে কাঁদছেন।
রাণী-মা’র বাড়ি পিপড়াদের মূল বসতবাড়িগুলি থেকে দূরে। শুধু দূরে নয় অনেকখানি দূরে। পিপড়াদের বসতবাড়ি মাটির নিচে, খুব নিচে নয় –অল্প নিচে। সূর্যের আলো যেন সেখানে যেতে পারে তার ব্যবস্থা আছে। রাণী-মা’র বাড়ি তারচেয়েও অনেক নিচে। সুরঙ্গ পথে যেতে হয়। সুরঙে কিছুক্ষণ পর পর পাহারা। বাজখাই গলায় পাহারাদাররা চেঁচিয়ে উঠে, কে? কে যায়?
পিপলী ভয়ে ভয়ে বলে –আমি। আমি পিপলী বেগম।
যাওয়া হচ্ছে কোথায়?
রাণী-মা’র বাড়ি। উনি ডেকে পাঠিয়েছেন?
পাশ আছে?
আছে।
আছে বলে হাবার মত দাঁড়িয়ে থেকো না। দেখাও।