তিলু বলল, আমিও দেখেছি।
শুধু নীলু দেখেনি। এই জন্যে নীলুর একটু মন খারাপ হল। মতিন সাহেব বললেন, আমাকে গল্প শেষ করতে দাও –কি বলছিলাম যেন?
নীলু বলল, তুমি বলছিলে একদল পিপড়া আছে এদের কাজ হল মাটি আনা। তাদের নাম –মাটি বাহক।
মতিন সাহেব বললেন, সেই মাটি চালুনি দিয়ে চেলে তাতে পানি মিশিয়ে, গাছের আঠা মিশিয়ে মাটি তৈরির কাজ করবে অন্যরা। তাদের নাম মাটি মিশ্রক। সেই তৈরি মাটি দিয়ে বাড়ি বানানোর কাজ আবার অন্যদের হাতে। তাদের বলে নির্মাতা পিপীলিকা।
আরেক দল আছে। যাদের কাজ খাদ্য অনুসন্ধান করা। এরা জায়গায় জায়গায় যাবে, খাদ্য খুঁজে বের করবে, খবর দেবে রাণী-মাকে। খাদ্যের নমুনাও খানিকটা ভেঙে নিয়ে আসবে। রাণীমা সেই খাদ্য চেখে দেখবেন। যদি দেখেন ভাল, তখন অন্য আরেক দলকে হুকুম দেবেন খাদ্য নিয়ে আসতে।
রাণী-মাকে পাহারা দেওয়া এবং পিপড়াদের নিরাপত্তার জন্য আছে বিশাল সৈন্যবাহিনী। তাদের দাঁতে আছে বিষ। এরা হিংস্র প্রকৃতির। যুদ্ধ করা ছাড়া তারা অন্য কোন কাজ জানে না। খাদ্য নিয়ে আসার সময় দলে দলে সৈন্য পাঠানো হয়। সৈন্যরা সারি বেঁধে যায়। রাস্তা ঠিক করে দেয়। অন্য কোন পোকা-মাকড় যাতে এই খাদ্য নিয়ে যেতে না পারে সেই দিকে তারা লক্ষ্য রাখবে। মাঝে মাঝে বড় ধরনের যুদ্ধও তাদের করতে হয়। এই যুদ্ধ হয় অন্য গোত্রের পিপড়াদের সঙ্গে। কিছুদিন আগেই এরকম একটা যুদ্ধে পিপলীদের দলের শত শত সৈন্য মারা পড়ল। এমন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ অনেকদিন হয়নি। ঘটনা কি হয়েছিল বলি —
পিপলীদের দল একটা বড় শুঁটকি মাছ পেয়েছিল। শুঁটকি মাছ হল পিপড়াদের জন্যে খুবই আদর্শ খাবার। পুষ্টিকর। উপাদেয়। অনেকদিন ঘরে রাখা যায়। নষ্ট হয় না। পিপলীদের সৈন্যবাহিনী পাহারা দিয়ে সেই খাবার নিয়ে যাচ্ছিল। কোন রকম সমস্যা হচ্ছিল না। হঠাৎ কালো পিপড়া গোত্রের একটা পিপড়াকে দেখা গেল এগিয়ে আসছে। সে ইশারায় বলল, কথা আছে। তার মুখ গম্ভীর।
পিপলীদের দলের একজন কর্নেল এগিয়ে গেল।
কি কথা?
কালো পিপড়া গম্ভীর গলায় বলল, আপনার পরিচয় দিন। আগে পরিচয়, তারপর কথা।
আমি রাণী-মা’র সৈন্যবাহিনীর একজন কর্নেল। আপনার কি পরিচয়?
আমি কালো গোত্রের একজন অনুসন্ধানী পিপড়া। এই যে খাবার তোমরা নিয়ে যাচ্ছ এই খাবার আমি প্রথম খুঁজে বের করি। তোমরা এটা নিয়ে যেতে পার না।
তোমার কথা সত্য না। তুমি যদি খাবার খুঁজে পেতে তাহলে খাবারের উপর তোমাদের পতাকা পুঁতে দিতে। সেই পতাকা দেখে আমরা বুঝতাম তোমরা খুঁজে পেয়েছ। খাবারের উপর তোমাদের পতাকা ছিল না।
আমাদের পতাকা পোতার নিয়ম নেই।
নিয়ম সবার জন্যই। সমস্ত পিপড় সম্প্রদায় এই নিয়ম মেনে চলে।
আমরা আগে মানতাম, এখন মানি না।
তুমি মিথ্যা কথা বলছ।
কাল পিপড়া হুংকার দিয়ে বলল, আমাকে মিথ্যাবাদী বলছ? তোমার সাহস তো কম না!
মিথ্যাবাদীকে মিথ্যাবাদী বলতে সাহস লাগে না।
কি বললে! আমি মিথ্যাবাদী?
হ্যাঁ।
তুমি কি যুদ্ধ করতে চাও?
আমি চাই না। আমাদের রাণী-মা অকারণে যুদ্ধ চান না। আমরা আমাদের খাবার নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের রাজ্যে ফিরে যেতে চাই।
শান্তিপূর্ণভাবে বাড়ি ফিরে যেতে চাও –খুব ভাল কথা। শান্তি সবাই চায়। আমরাও চাই। তবে সেই শান্তি পেতে হলে খাবার রেখে যেতে হবে।
তা সম্ভব না।
তাহলে যুদ্ধ হবে।
কালো পিপড়া কথা শেষ করেই একটু দূরে সরে গিয়ে ইশারা দিল। আর তখনি শত শত কালো পিপড়া বের হয়ে এল। তারা এতক্ষণ আড়ালে ঘাপটি মেরে বসেছিল। কালো পিপড়ারা যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হয়েই এসেছে। মুহূর্তের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে গেল। ভয়ংকর যুদ্ধ। কালো পিপড়ারা খুবই ভাল যোদ্ধা। এদের গায়ের জোর প্রচণ্ড। তাছাড়া তাদের সঁড়াশীর মত একটা অস্ত্র আছে। লাল পিপড়াদের তা নেই। তবে লাল পিপড়ারা অনেক সংঘবদ্ধ। এদের বুদ্ধিও বেশি। তারপরও লাল পিপড়ারা যুদ্ধে হেরে গেল। এদের শত শত সৈন্য মারা গেল। যারা বেঁচে গেল, কালো পিপড়ারা তাদের বন্দি করে নিয়ে গেল। বন্দি লাল পিপড়াদের এখন কাজ হচ্ছে কালো পিপড়াদের কাজকর্ম করে দেয়া। ওদের বাড়িঘর বানানো।
পিপলী বেগমের বাবা ঐ কালো পিপড়াদের হাতেই বন্দি। তিনি কেমন আছেন, কোথায় আছেন পিপলী বেগম কিছুই জানে না। মাঝে মাঝে বাবার জন্য সে কাঁদে। সবাই যখন খেলতে যায় সে যায় না চুপ করে বসে থাকে।
আজও বাড়ি ফিরে পিপলী বেগম চুপচাপ বসে রইল। পিপলীর মা বললেন, তোর কি হয়েছে রে?
পিপলী বলল, কিছু হয় নি।
কিছু হয়নি তো মুখ এমন অন্ধকার করে বসে আছিস কেন? স্কুলে আপার বকা খেয়েছিস?
না।
তাহলে এরকম চুপচাপ বসে থেকে রেশন কার্ড নিয়ে যা। খাবার নিয়ে আয়।
আমাদের খাবার যা আছে তাতে চলে যাবে মা। আর লাগবে না।
চিনি নেই তো। কয়েক দানা চিনি থাকা ভাল। বর্ষাকাল এসে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে এক-আধটু চিনি খেতে ভাল লাগে।
বেশি চিনি খাওয়া ভাল না, মা। ডায়াবেটিস হবে।
কে বলেছে তোকে?
স্কুলের আপা বলেছেন।
তোর দাদীমা’র চিনি খুব পছন্দ। এই বয়সে তাঁর অন্য কোন খাবার মুখে রুচে না। যা না রেশন কার্ডটা নিয়ে। লক্ষ্মী মা আমার। ময়না মা আমার।
যাচ্ছি, যাচ্ছি।
যাচ্ছিস যখন তখন তুই কি একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারবি?