থাকবে।
আচ্ছা, এখন বাসায় চলে যাও। বাসায় গিয়ে তৈরি হয়ে থেকো। কে জানে তিনি হয়ত আজই তোমাকে ডাকবেন। তোমার ভয় করছে না তো আবার?
একটু একটু করছে।
তা ভয় তো করবেই। আমার এত বয়স হল –এখনো রাণী-মা’র কাছে যাওয়ার কথা উঠলে শরীর কাঁপতে থাকে। এই দেখ, আমার শুড় দু’টা কাঁপছে। দেখতে পাচ্ছ?
পাচ্ছি।
রাণী-মা’র সামনে গঁড় কাঁপানো আবার এক ধরনের অসভ্যতা। তবে তিনি কিছু মনে করেন না –এটাই ভরসা।
বড় আপা রাণী-মা’র বাড়ির দিকে রওনা হলেন। পিপলী রওনা হল তার। বাড়ির দিকে।
.
পিপলীরা এক রুমের একটা ফ্ল্যাটে থাকে। সে, তার মা আর তার দাদীমা। দাদীমা’র অনেক বয়স হয়েছে। তিনি এখন চোখেও দেখেন না, কানেও খুব কম শুনেন। তবে কথা বলতে পারেন। দিনরাত বক বক করেন। কেউ তার কথা শুনছে কি শুনছে না তা নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা নেই। কথা বলেই যাচ্ছেন, বলেই যাচ্ছেন। পিপলী রাতে দাদীমা’র সঙ্গে শোয়। মাঝে মাঝে দাদীমা তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলেন, একটা মজার ইতিহাস মনে হয়েছে রে পিপলী, শোন।
আমার শুনতে ইচ্ছা করছে না দাদীমা।
কি বললি?
আমার শুনতে ইচ্ছা করছে না।
কি বলছিস একটু চেঁচিয়ে বল না।
চেঁচিয়েই তো বলছি। তুমি কানে শুনতে না পেলে কি করব? আমার ঘুম পাচ্ছে। গল্প শুনতে ইচ্ছা করছে না।
বড়ই মজার ইতিহাস। একটু শোন লক্ষ্মী মেয়ে। তোর মত বয়সে আমি একবার হারিয়ে গিয়েছিলাম, বুঝলি? কি হল শোন। কদিন খুব বৃষ্টি হল। বৃষ্টিতে আমাদের ঘরবাড়ি সব পানিতে ডুবে গেল। রাণী-মা বললেন, এই বাড়িঘর ছেড়ে নতুন জায়গায় যেতে হবে। নতুন আবাস বানাতে হবে। বলে রাণী-মা খুব কাঁদতে লাগলেন।
কোন রাণীমা? আমাদের এখনকার রাণী-মা?
উঁহু, উনার আগের জন।
রাণী হুকুম দিলেন –আমরা সব খাবার-দাবার নিয়ে তৈরি হলাম। রাণী মা’র কাছে বিদায় নিতে গেলাম। রাণী-মা চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন। আহা রে! কি কান্না! সেই কান্নার শব্দে পাষাণ গলে যায়। আমরাও খুব কাঁদলাম।
পিপলী অবাক হয়ে বলল, রাণীমা কাঁদছিলেন কেন?
রাণী-মা কাঁদছিলেন, কারণ, আমরা সবাই নতুন জায়গায় যাব –কিন্তু রাণী-মা যেতে পারবেন না।
উনি যেতে পারবেন না কেন?
রাণীদের বাড়ি ছেড়ে যাবার নিয়ম নেই। তাঁকে সেখানেই থাকতে হবে। বাড়িঘর পানিতে ডুবে গেলে তাঁকেও পানিতে ডুবে মরতে হবে। কাজেই আমরা রাণী-মাকে ফেলে রেখে কাঁদতে কাঁদতে রওনা হলাম। আহা, কি কষ্ট! যাবার পথে আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম। সে এক বিচিত্র ইতিহাস। শুনবি?
বিচিত্র ইতিহাস শুনব না। তুমি ঐ রাণী-মা’র কথা বল।
আহারে বড় ভাল রাণী ছিল। আমরা উনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসবার সময়, তিনি আমাদের সবাইকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলেন।
তোমাকেও চুমুদিলেন।
হ্যা দিলেন। ভাল কথা আরেকটা মজার গল্প মনে হয়েছে। শুধু যে মজার তাই না, বিচিত্র ইতিহাস বলি?
না। ঘুম পাচ্ছে।
ছড়া শুনবি?
না।
বৃষ্টির ছড়া একটা শোন না। মজা লাগবে।
আমার এখন বৃষ্টির ছড়া শুনতে ইচ্ছা করছে না, দাদীমা। ঘুমুতে ইচ্ছা করছে।
ছড়া শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়। ছড়া শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তে অনেক বেশি মজা। বৃষ্টি যখন অসি আসি করে তখন এই ছড়া সুর করে পড়তে হয়। এই ছড়া পড়লে বৃষ্টি আসে না —
যা বৃষ্টি যা,
যেখান থেকে এসেছিলি
সেইখানেতে যা।
সেইখানে তোর মা আছে
মায়ের কাছে আদর আছে।
যা বৃষ্টি যা।
মায়ের কোলে বসে বসে
মায়ের আদর খা।
দাদীমাকে নিয়ে পিপলীর খুব সমস্যা
দাদীমাকে নিয়ে পিপলীর খুব সমস্যা হয়েছে। সারারাত জেগে পিপলীকে কবিতা শুনাবে, গল্প শুনাবে, ছড়া শুনাবে। সবচে সমস্যা হয় যখন গান শুরু করেন। দাদীমা’র গলা খারাপ। গানের সুরেরও কোন আগামাথা নেই। এই গানের সুর অন্য গানে, এক গানের কথা অন্য গানে। এমন বিরক্তিকর ব্যাপার। রাত জেগে জেগে হাত পা নেড়ে গান। দাদীমা’র ঘুম হয় না –সে পিপলীকেও ঘুমুতে দেয় না। তারা যদি একটা দুরুমের ফ্ল্যাট পেত খুব ভাল হত। দাদীমাকে একটা রুম দিয়ে দেয়া যেত। দুরুমের একটা ফ্ল্যাট তাদের পাওয়ার কথা কিন্তু তারা পাচ্ছে না। কারণ বাড়ি বানানোর মাটি পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়ির মাটি আনতে হচ্ছে অনেক দূর থেকে। সেখানে যাওয়া যেমন কষ্ট, পথও তেমনি বিপদজনক। কাছেই অবশ্যি ভাল মাটি পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু রাণী-মা সেই মাটি পছন্দ করলেন না।
রাণী মা বললেন, আমি জানি এই মাটি ভাল। এই মাটির ঘর মজবুত হবে তাও জানি –কিন্তু এই মাটির গন্ধ আমার পছন্দ হচ্ছে না। তোমাদের মাটি আনতে হবে দূর থেকে। জানি, তোমাদের কষ্ট হবে। মাটি আনতে গিয়ে অনেকেই মারা পড়বে। তবে সেই মৃত্যু হবে সুখের মৃত্যু। কারণ যারা মারা যাবে তারা মারা যাবে অন্যের সুখের জন্য। এই মৃত্যু বড়ই আনন্দের মৃত্যু। তোমাদের কাজ করতে হবে দিনরাত। বিপদকে তুচ্ছ করতে হবে।
পিপড়ারা তাই করে যাচ্ছে। তাদের সব কাজ ভাগ ভাগ করা। যারা মাটি আনে –তাদের কাজই হল মাটি আনা। তারা অন্য কাজ করবে না। তারা হল মাটি-বাহক। সারা বৎসর তারা শুধু মাটিই আনে। অবশ্যি খুব জরুরী পরিস্থিতিতে তারা পিপড়ার ডিম নিয়ে এক জায়গা থেকে একজায়গায় যায়।
বিলু বলল, বাবা আমি পিপড়াদের মুখে ডিম নিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে দেখেছি।