কি সর্বনাশের কথা! কি সর্বনাশের কথা! তোমার শরীর ভাল আছে তো পিপলী বেগম? অনেক সময় শরীর খারাপ হলে উদ্ভট চিন্তা-ভাবনা মাথায় আসে। তোমার কি রাতে ভাল ঘুম হয়?
মাঝে মাঝে ঘুম হয় না। মন খারাপ লাগে।
যা ভেবেছি তাই। তোমার শরীর খারাপ। শরীর খারাপ হলেই মন খারাপ হয়। কারণ মন বলে আলাদা কিছু নেই। আমার ধারনা তোমার শরীর খুবই খারাপ।
আমার শরীর ভালই আছে আপা।
তুমি বললে তো হবে না। ডাক্তার এসে দেখে বলুক। আমরা ধারণা তোমার জটিল কোন রোগ হয়েছে। খুব জটিল। এসো মা, তুমি এই টেবিলে শুয়ে থাক। আমি স্কুলের ডাক্তারকে খবর দিচ্ছি। ডাক্তার সাহেব এসে দেখুক।
বিলু বলল, বাবা, পিপড়াদের ডাক্তার আছে?
মতিন সাহেব বললেন, পিপড়াদের তুমি এত তুচ্ছ ভাবছ কেন মা? ওদের ডাক্তার আছে –ওদের হাসপাতাল পর্যন্ত আছে। ওদের যে বসতবাড়ি, সেই বসতবাড়ির একটা তলা হল ওদের হাসপাতাল। হাসপাতালে রুগ্ন, অসুস্থ পিপড়ারা থাকে। অসুখ-বিসুখ ওদের বেশি হয় না, কিন্তু একসিডেন্ট খুব বেশি। বেশির ভাগ রোগী আসে হাত ভাঙা, পা ভাঙা। অর্থাৎ পঙ্গু হাসপাতাল।
তারপর কি হল শোন। পিপলী বেগমের বড় আপা খুব ব্যস্ত হয়ে ডাক্তার ডেকে পাঠালেন। পিপলীকে শুইয়ে রাখলেন টেবিলের উপর। বড় আপার চিন্তার সীমা রইল না। স্কুলের দুজন ডাক্তার এসে নানাভাবে দেখলেন। জিভ দেখলেন, কান দেখলেন, গলা দেখলেন। ব্লাড প্রেসার মাপলেন। একটা ছোট্ট কাঠের হাতুরী দিয়ে টুক করে পিপলীর হাঁটুতে বাড়ি দিয়ে রিফ্লেক্স এ্যাকশান দেখলেন।
বড় আপা ভীত গলায় বললেন, কি দেখলেন ডাক্তার সাহেব? আমার খুব চিন্তা লাগছে। এতদিন ধরে স্কুলে পড়াচ্ছি, এমন তো কখনো শুনিনি! পিপলীর শরীর কি খুব বেশি খারাপ?
ডাক্তার সাহেব গম্ভীর মুখে বললেন, শরীরে তেমন কিছু পাচ্ছি না। বুকে কফ জমে আছে। ঠাণ্ডা লেগেছে বোধহয়। অবশ্যি ব্লাড প্রেসার নরমালের চেয়ে সামান্য নিচে। ভালমত খাওয়া-দাওয়া করতে হবে। ওকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিন। দিনকয় বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিক।
বেড রেস্টে থাকুক।
নীলু বলল, বাবা পিপড়ারা কি ইংরেজীও জানে?
দু একটা শব্দ জানে।
ওরা কোন ভাষায় কথা বলে বাবা? বাংলা ভাষা?
না ওদের ভাষা হচ্ছে পিপ-ভাষা। তোমরা কথা কিন্তু বেশি বলছ মা। এত কথা বললে গল্প বলব কখন।
আর কথা বলব না বাবা তুমি গল্প শুরু কর।
বড় আপা ঠিক করলেন পিপলীকে ছুটি দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেবেন। সাতদিনের ছুটি। পড়াশোনার ক্ষতি হবে। কি আর করা! বাড়তি ক্লাস নিয়ে ক্ষতি পুষিয়ে দিতে হবে। তাছাড়া রাণীমাকে খবরটা দিতে হবে। এতবড় ঘটনা রাণী মাকে না জানালে হবে না।
নীলু বলল, ওদের রাজা-রাণী আছে?
রাজা নেই, রাণী আছে। রাণীর ভয়ংকর ক্ষমতা। পিপড়াদের কারোর অতি সামান্য কিছু হলেও রাণীকে জানাতে হয়। কি কথা ছিল মা? বেশি প্রশ্ন করবে না। তুমি একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছ। যাই হোক, তারপর কি হল শোন –বড় আপা বললেন, পিপলী, তোমার ব্যাপারটা তো রাণী-মাকে জানাতে হয়। আমি নিজেই গিয়ে জানাব। উনি কি করবেন তা তো জানি না। হয়ত তোমাকে ডেকে পাঠাবেন। তোমার কি কখনো রাণী-মা’র সঙ্গে দেখা হয়েছে?
না।
তাহলে রাণী-মা’র সঙ্গে কথা বলার নিয়ম-কানুন খুব ভাল করে শিখে রাখ। কথা বলবে খুব আদবের সঙ্গে। খুব জোরেও বলবে না, আবার ফিসফিস করেও বলবে না। মনে থাকবে?
থাকবে।
রাণী-মা’র বাড়ির চারপাশে লাল দাগ দেয়া। বৃত্তের মত। কখনো ভুলেও সেই লাল দাগের ভেতরে যাবে না। লাল দাগের ভেতরে যাওয়া মানেই মহাসর্বনাশ।
কি সর্বনাশ?
সারা জীবনের জন্যে নির্বাসনদণ্ড। পিপীলিকা সমাজে মৃত্যুদণ্ড নেই। মৃত্যুদণ্ড থাকলে, মৃত্যুদণ্ডই হত। খুব মনে রাখবে –লাল দাগ।
পিপলী বলল, রাণী-মা দেখতে কেমন?
জানি না কেমন। আমরা কেউ কখনো দেখিনি। কেউ দেখা করতে গেলে উনি প্রাসাদের জানালার সামনে এসে বসেন। সেই জানালায় পর্দা দেয়া। কেউ তাকে দেখতে পায় না। তাছাড়া জানালার দিকে তাকানোও এক ধরনের অসভ্যতা। তাকালেও নির্বাসনদণ্ড হতে পারে। অনেকের হয়েছে।
এত কঠিন নিয়ম-কানুন কেন?
কি আশ্চর্য! রাণী-মা’র নিয়ম-কানুন কঠিন হবে না? উনি কি আর তোমার আমার মত সাধারণ? ও আচ্ছা, বলতে ভুলে গেছি —রাণী-মা যদি কথায় কথায় কোন হাসির কথা বলেন, তাহলে হাসবে কিন্তু খুব শব্দ করে হাসবে না।
শব্দ করে হাসলে কি হয়?
অসভ্যতা হয়। উনার সামনে অসভ্যতা করা যায় না।
উনি কি হাসির কথা বলেন?
বলবেন না কেন? বলেন। একবার কি হল শোন –আমি রাণী-মা’র সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি। উনি এমন এক হাসির গল্প বললেন যে আমার মরে যাবার মত অবস্থা। এত হাসি আসছে, হাসতেও পারছি না –হাসলে যদি বেয়াদবী হয়। রাণী-মা আমার অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন, আচ্ছা এখন যাও। অন্য একদিন এসো। আমি ছুটি পেয়ে দৌড়ে রাস্তায় এসে হো হো করে হাসলাম।
পিপলী বলল, রাণী-মা কি আমাকেও হাসির গল্প বলবেন?
তা তো জানি না পিপলী। তোমার সঙ্গে উনি কি গল্প করবেন তা উনিই জানেন। তবে একটা কথা মনে রেখ –রাণীমা কোন প্রশ্ন করলে সত্যি জবাব দেবে। ভুলেও মিথ্যা বলবে না, কিংবা চুপ করে থাকবে না।
জি আচ্ছা।
আর রাণী-মা’র সঙ্গে কথা বলার আগে দুহাতে মাথা চেপে ধরে বলবে –হে পিপড়া সম্প্রদায়ের মহান রাণী। আপনার মঙ্গল হোক। কল্যাণ হোক। মনে থাকবে?