নীলু বলল, বাবা, ওদের স্কুল আছে?
অবশ্যই আছে। স্কুল থাকবে না কেন? স্কুল আছে, কলেজ আছে। সেখানে সবাইকে পড়াশোনা করতে হয়।
ওদের স্কুলগুলি কেমন বাবা?
ওদের স্কুলগুলি বেশির ভাগই রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের মত। খোলা ময়দানে ক্লাস হয়। কখনো গাছের নিচে। কখনো গাছে। তবে ঝড়-বাদলার দিনে স্কুলঘরে।
ওদের স্কুলঘর আছে?
আছে। দুতলা-তিনতলা স্কুলঘর। পিপড়ারা যে খুব সুন্দর বাড়ি বানাতে পারে তা তুমি জান না?
না।
ওরা মাটির নিচে বাড়ি বানায়। সুন্দর সুন্দর বাড়ি। বাড়িতে পানি আছে –ইলেকট্রিসিটি আছে।
তিলু রাগী গলায় বলল, বাবা, তুমি বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলা শুরু করেছ। ওরা ইলেকট্রিসিটি কোথায় পাবে?
মতিন সাহেব হাসিমুখে বললেন, ওদের ইলেকট্রিসিটি মানুষের ইলেকট্রিসিটির মত না। এক ধরনের পচা কাঠ আছে, অন্ধকারে জ্বলে। ওরা করে কি –ঐসব কাঠের ছোট ছোট টুকরা নিজেদের বাড়ির হলরুমে রাখে। ওদের মিটিং-টিটিং তো সব হলঘরে হয় –এই জন্যেই শুধু হলঘরে আলোর ব্যবস্থা।
বিলু বলল, বাবার কথা আমার মোটেই বিশ্বাস হচ্ছেনা। মনে হচ্ছে বাবা বানিয়ে বানিয়ে বলছে। তিলু বলল, আমার কেন জানি বিশ্বাস হচ্ছে।
নীলু বলল, বাহ্, বাবার সব কথা আমার বিশ্বাস হচ্ছে। বাবা তুমি বল। পিপড়াদের কি মজা তাই না বাবা।
মজা তো বটেই। আমরা মানুষ ছাড়া অন্য সবাইকে খুব ছোট করে দেখি। ছোট করে দেখা ঠিক নয়। বুঝলে মা? প্রাণীদেরও বুদ্ধি আছে। অনেক বুদ্ধি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানুষদের বুদ্ধির চেয়েও বেশি। বাবুই পাখি কি করে জান?
না। কি করে?
ওরা ওদের বাড়িতে জোনাকি পোকা ধরে রাখে। প্রথমে খানিকটা গোবর নিয়ে যায়, সেই গোবরে জোনাকি পোকা পুঁতে দেয়। এতে ঘর আলো হয়।
বাবুই পাখিদেরও কি স্কুল আছে?
সবারই স্কুল আছে। সবাইকে শিখতে হয়। তবে পিপড়াদের স্কুল হল খুব ভাল স্কুল। এরা অনেক কিছু শেখায়।
বিলু বলল, কি কি শেখায়?
অঙ্ক তো শিখতেই হয়। হিসেব-নিকেশ না শিখলে চলবে কেন? তারপর শিখতে হয় মাটিবিদ্যা। ওরা মাটিতে থাকে, মাটি দিয়ে ঘর বানায় –মাটিবিদ্যা শিখলে চলবে কেন? ওদের ভূগোল খুব বেশি বেশি পড়তে হয়। কোন জায়গাটা কি রকম তা না জানলে ওদের চলে না। আবহাওয়া জানতে হয় –কখন বৃষ্টি হবে, কখন ঝড় হবে …
তিলু বলল, বাবা, ওদের কি সায়েন্স, আর্টস আছে?
আছে। তবে আর্টস পড়ে খুব কম পিপড়া। যারা অসম্ভব জ্ঞানী তারাই শুধু আর্টস পড়ে। ওদের কাজ হচ্ছে চিন্তা করা।
কি চিন্তা করে?
নানান বিষয় নিয়ে চিন্তা করে। পিপড়া কেন পৃথিবীতে তৈরি করা হল, এদের কি প্রয়োজন ছিল। এইসব ….।
নীলু বলল, পিপড়া হওয়া তো বাবা খুব মজা।
মজা তো বটেই। তারপর শোন কি হল, স্কুলের বড় আপা পিপলী বেগমকে ডেকে নিয়ে গেলেন। বড় আপা বললেন, পিপলী, তোমার রেজাল্ট এত খারাপ হল কেন? অঙ্কে উনিশ, ভূগোলে তেইশ। ব্যাপারটা কি বল তো?
পিপলী বলল, পড়তে আমার ভাল লাগে না, আপা।
বড় আপা অবাক হয়ে বললেন, কি বললে?
পড়তে ভাল লাগে না।
বড় আপা অবাক হয়ে পিপলীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই প্রথম একজনকে পাওয়া গেল যার পড়তে ভাল লাগে না। পিপড়ারা মানুষের মত। তাদের সবারই পড়তে খুব ভাল লাগে। এমন একজনকেও পাওয়া যায় না, যার পড়তে ভাল লাগে না। শুধু পিপলী বেগমকে পাওয়া গেল।
বিলু বাবার কানের কাছে মুখ এনে ফিস ফিস করে বলল, বাবা আমারো পড়তে ভাল লাগে না। মতিন সাহেব বললেন, তোমার কথাতো এখন হচ্ছে না। এখন পিপলী বেগমের কথা হচ্ছে। তোমার কথা পরে শুনব। যা বলছিলাম –পিপলীর পড়তে ভাল লাগে না শুনে বড় আপা বললেন, এত অদ্ভুত কথা তো আমি জন্মেও শুনিনি। তোমার কি সত্যি সত্যি পড়তে ভাল লাগে না? নাকি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছ?
আমার সত্যি সত্যি পড়তে ভাল লাগে না। পড়ার কথা মনে হলেই রাগ লাগে। স্কুলে আসতেও ইচ্ছা করে না। অদ্ভুত অদ্ভুত সব ইচ্ছা হয়।
অদ্ভুত ইচ্ছা হয়? কি রকম অদ্ভুত ইচ্ছা?
বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছা করে। অনেক, অনেক দূরে চলে যেতে ইচ্ছা করে। পৃথিবীটা ঘুরে দেখতে ইচ্ছা করে।
বড় আপা চেঁচিয়ে বললেন, কি দেখতে ইচ্ছা করে?
সবচে বেশি দেখতে ইচ্ছা করে মানুষদের।
মানুষদের দেখতে ইচ্ছা করে! তুমি তো ভয়ংকর কথা বললে! মানুষরা ভয়াবহ জীব। এদের কাছ থেকে দূরে থাকতে হয়। অনেক দূরে। মানুষ কি করে জান? পিপড়া দেখলে পায়ে পিষে মেরে ফেলে। বিশেষ করে মানুষদের হোট ছোট বাচ্চারা পিপড়া মা’রতে খুব ভালবাসে।
তবু আমার মানুষ দেখতে ইচ্ছা করে। ওদের কত বুদ্ধি!
মানুষদের বুদ্ধি আছে। এই অদ্ভুত কথা তোমাকে কে বলল, পিপলী? এই পৃথিবীতে সবচে বোকা হল মানুষরা। আমরা যেমন খাবার ভাগাভাগি করে খাই, ওরা তা করে না। কোন কোন মানুষের বাড়িতে প্রচুর খাবার। আবার কারো কারো বাড়িতে কোন খাবার নেই। কারো কারো থাকার জন্যে বাড়ি আছে, কারো কারো নেই –তারা থাকে পথে, গাছের নিচে। পিঁপড়াদের বেলায় এই জিনিস কখনো হবে না। কখনো না।
তবু আমার মানুষ দেখতে ইচ্ছা করে। ওদের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করে।
ওদের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করে?
হু। ওদেরকে বলতে ইচ্ছা করে এই যে মানুষ, তোমাদের এত বুদ্ধি কিন্তু তোমরা এমন কেন?