কারণ জায়গাটা খুব অন্ধকার।
তুমি যে ভয় পাচ্ছ তাতে কি কোন লাভ হচ্ছে –অন্ধকার কমে যাচ্ছে?
না।
তাহলে ভয় পাচ্ছ কেন? ভয়ে তোমার কোন লাভ হচ্ছে না। বরং ক্ষতি হচ্ছে। কাজেই ভয় দূর কর। যা করছিলে কর। তুমি এখন কি করছ?
হাঁটছি।
তাহলে হাঁটতে থাক। তুমি কি গান জান?
জানি।
গান গাইতে গাইতে হাঁট।
পিপলী গান ধরল —
এসো ভাই, গান গাই
গান গেয়ে মজা পাই
গান গাইতে গাইতে পিপলী এগুচ্ছে –হঠাৎ ধমকের শব্দে সে চমকে উঠল —-কে গান গায়?
পিপলী থমকে দাঁড়াল। ভীত গলায় বলল, আমি।
আমি কোন পরিচয় নয়। আমার নাম পিপলী বেগম।
তুমি মেয়ে পিপড়া?
হ্যাঁ
এসো পিপলী, এসো। আজ আমাদের বড়ই আনন্দের দিন। আজ আমাদের হৃদয় আনন্দে পরিপূর্ণ হল। এতদিনের প্রতিক্ষার অবসান হল।
আমি কিছুই বুঝতে পরাছি না। আপনি কে?
আমার নাম অরং। আমি অতি বৃদ্ধ এক পিলিলিকা। রাণী-মা তোমাকে যেমন নির্বাসন দিয়েছেন, আমাকেও দিয়েছেন। আমার মত হাজার হাজার পিপড়াকেও দিয়েছেন। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস আমরা অপেক্ষা করেছি একটি মেয়ে পিপড়ার জন্যে। আজ তোমাকে পাওয়া গেল। কি আনন্দ! কি আনন্দ।
পিপলী অন্ধকারে কিছুই বুঝতে পারছে না। কিন্তু টের পাচ্ছে এই বুড়ো পিপড়া যার নাম অরং, সে আনন্দে লাফাচ্ছে। হাততালি দিচ্ছে। অরং কি পাগল? পাগল হবারই কথা। দীর্ঘদিন অন্ধ কূপে থেকে থেকে মাথা খারাপ হয়েছে। পিপলী ক্ষীণ গলায় ডাকল –বৃদ্ধ অরং।
কি গো মা!
আপনি এমন লাফালাফি করছেন কেন?
খুব আনন্দ হচ্ছে তো মা –তাই লাফালাফি করছি।
আপনি পাগল হয়ে যাননি তো?
হতেও পারি। হয়ত আনন্দে পাগল হয়ে গেছি। তুমি সত্যি পিপলী বেগম তো? আমি স্বপ্ন দেখছি না তো?
না, আপনি স্বপ্ন দেখছেন না। আপনি দয়া করে আমার হাত ধরুন। হাত ধরে নিয়ে চলুন। আমার ভীষণ ভয় লাগছে।
অরং এসে হাত ধরল।
তারা হাঁটতে শুরু করল। মাঝে মাঝে বৃদ্ধ অরং পিপলীর হাত ছেড়ে দিয়ে খানিকক্ষণ নাচানাচি করে নেয়। বিকট শব্দে চিৎকার করে। পাওয়া গেছে, পাওয়া গেছে। পিপলী বেগম চলে এসেছে। তারপর আবার হাঁটা শুরু করে। তারা নানান সুরঙ্গ পার হল। পথ যেন শেষ হতেই চায় না। হাঁটতে হাঁটতে তারা এক সময় সুরঙ্গ ছেড়ে একটা খালি ময়দানে এসে পড়ল। সেখানে হাজার হাজার পিপড়া অপেক্ষা করছে। পিপড়াগুলিকে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু এদের নিঃশ্বাসের শব্দ পিপলী শুনতে পাচ্ছে।
বৃদ্ধ অরং চেঁচিয়ে বলল, সুসংবাদ। সবার জন্যে সুসংবাদ। বড়ই সুসংবাদ। আমরা পেয়ে গেছি পিপলী বেগমকে। এতদিন যার জন্যে আমরা অপেক্ষা করছিলাম, তাকে আমরা পেয়ে গেছি। সবাই হাততালি দিন।
তুমুল হাততালি হল। শুধু হাততালি না –সবাই একসঙ্গে লাফাতে লাগল। পিপলী কিছুই বুঝতে পারল না। সে অরংকে কানে কানে বলল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। এসব কি হচ্ছে?
বুঝবে, কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝবে। তোমাকে সব বুঝিয়ে দেয়া হবে। আমরা এতদিন তোমার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম —পেয়ে গেছি। আমরা পেয়ে গেছি।
সবাই একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, পেয়ে গেছি। আমরা পেয়ে গেছি।
তাদের লাফালাফি, হৈচৈ আর থামতেই চায় না। এক সময় তারা বৃদ্ধ অরং এবং পিপলীকে কাঁধে তুলে নাচতে লাগল। এবং বিকট স্বরে চেঁচাতে লাগল –পাওয়া গেছে, পাওয়া গেছে। পিপলী আবারো ফিসফিস করে বৃদ্ধ অরংকে বলল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
বৃদ্ধ অরং বলল, আমাদের পিপলী বেগম কিছুই বুঝতে পারছে না। এখন তাকে আমরা সব বুঝিয়ে দেব। আপনারা হৈচৈ বন্ধ করুন।
হৈচৈ থেমে গেল।
বৃদ্ধ অরং বলল, পিপলী বেগম, তুমি খুব মন দিয়ে আমার কথা শুনবে। শুধু শুনলে হবে না। কথা শুনবে এবং সেই সঙ্গে বুদ্ধি দিয়ে জ্ঞান দিয়ে বিচার করবে।
পৃথিবীতে অসংখ্য পিপীলিকা গোত্র আছে। সব গোত্রেরই রাণী আছে। আমাদের গোত্রেরও আছে। আমাদের রাণীদের সঙ্গে অন্য রাণীদের কিছু অমিল আছে। অমিলগুলি মন দিয়ে শোন —
এই রাণী মা, আমাদের কোন খাবার খান না। যত ভাল খাবারই হোক তিনি পুরোটা ফিরিয়ে দেন। ঠিক না?
ঠিক ঠিক।
সব গোত্রের পিপীলিকা রাণী থাকেন পিপীলিকাদের মাঝখানে। তিনি থাকেন, মাঝখানে তাঁকে ঘিরে থাকে অন্যরা। তিনি কখনোই আলাদা থাকেন না। আমাদের রাণীমা থাকেন আলাদা। অনেক আলাদা। ঠিক কিনা বল তো পিপলী?
ঠিক ঠিক?
সব গোত্রের রাণী-মা’র কাছে যাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের রাণী-মা’র কাছে যাওয়া যায় না। তিনি থাকেন লাল দাগের ভেতরে। সেই লাল দাগের ভেতরে কেউ গেলে সঙ্গে সঙ্গে নির্বাসন। কেন বল তো পিপলী বেগম?
আমি জানি না।
চিন্তা কর।
চিন্তা করে কিছু পাচ্ছি না।
রাণী-মা লাল দাগ দিয়ে রেখেছেন যাতে কেউ তাঁর কাছে যেতে না পারে। তিনি সাধারণত কাউকে দেখা দেন না। তবু যদি ভুলে কেউ দেখে ফেলে সে জন্যেই এই সতর্কতা। কারণ কেউ ভালমত তাকালেই বুঝে ফেলবে আমাদের রাণী-মা আসলে অন্ধ।
রাণী মা অন্ধ।
হ্যাঁ অন্ধ। আমাদের রাণী মা জন্মান্ধ।
সে কি!
শুধু রাণী-মাই না, রাণী-মা’র প্রাসাদে যারা থাকে তারাও অন্ধ। যে মেয়েসৈন্যরা রাণী-মাকে ঘিরে থাকে তারাও অন্ধ।
হ্যাঁ তাই তো!
এখন বল, এই পৃথিবীতে কোন্ প্রজাতি জন্মান্ধ?
উই পোকা।
এখন বল পিপলী বেগম –রাণী মা কি তোমাকে কোন খাবার দিয়েছিলেন?
হু। নিশা ফুলের মধু।