তোমার কথা কি শেষ হয়েছে?
হয়েছে।
তুমি যখন নাচানাচি করছিলে তখন তোমার পা লাল দাগের ভেতর পড়েছিল। লাল দাগে পা পড়া কি তা তো তুমি জান পিপলী। জান না?
জানি।
যদি জান, তাহলে বল তো কি শাস্তি?
নির্বাসন।
হু, নির্বাসন। নির্বাসনের শাস্তি আগে ছিল –এখন তা বদলেছি। এখন থেকে শাস্তি হচ্ছে মৃত্যু। আগুনে পুড়িয়ে মৃত্যু। আগুনে পুড়িয়ে মৃত্যু।
রাণী মা আমার পা কিন্তু লাল দাগে পড়ে নি। আমি খুব সাবধান ছিলাম।
রাণীর সঙ্গে তর্ক করার শাস্তিও কিন্তু মৃত্যুদন্ড। আগুনে পুড়িয়ে মৃত্যু।
এই শাস্তি কবে থেকে চালু হল রাণী-মা?
এখন থেকে। আজ থেকে তবে তোমার বয়স অল্প। এবং আমি দয়া দেখাতে ভালবাসি বলেই তোমাকে নির্বাসন দেব। আগুনে পুড়িয়ে মা’রব না। তোমার নির্বাসন হবে অন্ধকূপে। সেখানে আলো নেই, বাতাস নেই এবং খাদ্য নেই তোমার মৃত্যু হবে –তবে কিছুদিন বেঁচে থাকবে। কিছুদিন বেঁচে থাকাও তো ভাগ্যের ব্যাপার। তাই না পিপলী বেগম?
জী রাণী-মা, ভাগ্যের ব্যাপার। আপনার অসীম দয়া।
রাণী-মা’র নির্দেশে মেয়ে সৈন্যরা এসে পিপলীকে ধরে নিয়ে গেল। পিপলী অবাক হয়ে দেখল –মেয়ে সৈন্যরাও সবাই অন্ধ। তারা তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে কূপের দিকে। পিপলী বেগম বলল, অন্ধ কূপে ফেলার আগে আমি কি আমার মা এবং দাদীমা’র সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি?
ওরা কর্কশ গলায় বলল, না।
পিপলী বলল, আমি কোন কথা বলব না, শুধু একবার তাঁদের দেখব।
না
অনেক দূর থেকে দেখব –শুধু একবার।
না।
তারা পিপলীকে অন্ধকূপে ফেলে দিল। গহীন সেই কূপ। পিপলী পড়ছে তো পড়ছেই। মনে হচ্ছে এই কূপ কখনো শেষ হবে না। ঘড়ঘড় শব্দে কূপের মুখ পাথর-চাপা দেয়া হল। চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। সেই অন্ধকার ভয়াবহ অন্ধকার। পিপলী ডাকল –মা! মাগো! কেউ তার ডাক শুনতে পেল না। সে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। দেয়ালে ঘা খেয়ে তার কান্নার শব্দ তার কাছেই ফিরে আসছে। মনে হচ্ছে অসংখ্য পিপলী বেগম এক সঙ্গে কাঁদছে।
.
গল্প এই পর্যন্ত বলে মতিন সাহেব হাই তুলে বললেন, এবার খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমুতে গেলে কেমন হয়? রাত কম হয়নি। তিন মেয়েই একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল –না-না-না। নীলু বলল, পিপলী বেগমকে জেলখানায় রেখে গল্প শেষ করা যাবে না। কিছুতেই না। কিছুতেই না। কিছুতেই না।
আমাকে কি করতে হবে?
তা আমি জানি না।
বিলু বলল, বাবা রাণী-মাকে আমার এত ভাল মনে হয়েছিল, সে এখন এত খারাপ হল কি ভাবে?
তা তো আমি বলতে পারি না, মা।
তিলু বলল, ঐ দেশে রাজা নেই, বাবা?।
না। পোকা-মাকড়দের দেশে রাজা নেই বললেই হয়। মৌমাছিদের বেলাতেই দেখ। ওদের আছে রাণী মৌমাছি। রাজা মৌমাছি বলে কিছু নেই। মৌমাছিদের রাণী মহাসুখে থাকে। অন্য মৌমাছিদের কষ্ট করে নিয়ে আসা মধু চুকচুক করে খায়। অন্যরা খেটে মরে তার জন্যে।
নীলু বলল, অন্যরা খাটাখাটানি না করলেই হয়। অন্যরা কেন বলে না –তুমি পচা রাণী, আমরা তোমার কাজ করব না। করব না, করব না।
মতিন সাহেব বললেন, এরকম কিছু বললে তো হবে না। কীট-পতঙ্গের জগতে এই ধরনের কথা বলা যায় না। ওদের জগতের আইন-কানুন, খুবই কড়া। ওদের জগতের রাজা-রাণীদের আইন বড়ই কঠিন আইন।
নীলু কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আমাদের পিপলী বেগম যে অন্ধকূপে চলে গেল, এখন কি হবে বাবা?
দেখা যাক কি হয়।
ও কি ছাড়া পাবে?
বুঝতে পারছি না। গল্প শেষ হোক। শেষ হলে বোঝা যাবে।
মতিন সাহেব আবার শুরু করলেন –চরম বিপদে পিপড়াদের কি করতে হয় তা স্কুলে শেখানো হয়। যেমন পানিতে পড়ে গেলে কি করতে হবে, আগুনের কাছাকাছি চলে গেলে কি করতে হবে –এইসব। কিন্তু অন্ধ কূপে কাউকে আটকে ফেললে কি করতে হবে স্কুলে তা শেখানো হয় নি। কোন বই এও কিছু লেখা নেই। পিপলী বেগম অনেক উঁচু থেকে নিচে পড়েছে, কিন্তু ব্যথা পায়নি। তার কারণ সে স্কুলে বইএ পড়েছে –উঁচু থেকে হঠাৎ নিচে পড়ে গেলে কি করতে হয়। মাটির দিকে পা এবং শুড় বাড়িয়ে দিতে হয়। প্রচণ্ড চাপে পা, শুড় ভেঙে যাবে তবে ভয় পাবার কিছু নেই। শুড় ও পা সবই গজাবে। নতুন পা এবং নতুন গঁড় হবে আগের চেয়েও মজবুত।
পিপলী প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছে। তার শুড় ভেঙেছে কিন্তু পা ভাঙে নি। সে তীব্র ব্যথা নিয়ে এখন এগুচ্ছে অন্ধের মত। কেন এগুচ্ছে তাও জানে না। সে বুঝতে পারছে পুরো জায়গাটা পাথরের তৈরি। মাটির তৈরি হলে মাটি ফুটো করে বের হবার একটা চেষ্টা করা যেত। অবশ্যি সে চেষ্টা করলে লাভ হত না, কারণ মাটি ফুটো করার বিদ্যা সে জানে না।
পিপলীর ভয় ভয় করছে। একা থাকার ভয়। অন্ধকারের ভয়। ভয় কাটানোর জন্যে সে বলল –কেউ কি আছে?
তার নিজের কথাই দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এল। বার বার শব্দ হতে লাগল, কেউ কি আছে? কেউ কি আছে? কেউ কি আছে?
ভয় লাগছে। পিপলীর প্রচণ্ড ভয় লাগছে। ভয় লাগলে কি করতে হয় স্কুলে পড়িয়েছে। ভয় পেলে নিজেকে প্রশ্ন করতে হয়। কি কি প্রশ্ন করতে হয় তাও বইয়ে লেখা। সেই প্রশ্নের জবাব নিজেকেই দিতে হয়। প্রশ্নগুলির জবাব দিলেই ভয় কমে যাবার কথা। পিপলী নিজেকে প্রশ্ন করা শুরু করল।
পিপলী, তুমি কি ভয় পাচ্ছ?
হ্যাঁ।
খুব বেশি ভয় পাচ্ছ?
হ্যাঁ।
কেন ভয় পাচ্ছ, পিপলী?