রাণী মা?
বল, আমি শুনছি।
আমরা সব সময় বলি –পিপীলিকা সম্প্রদায়ের মহান রাণী –আপনার মঙ্গল হোক, কল্যাণ হোক। আমরা সব সময় আপনার মঙ্গল চাই, কল্যাণ চাই —-কিন্তু আপনি আমাদের মঙ্গল চান না।
এ রকম কথা কেন বলছ?
রাণী-মা, আমি অনেক চিন্তা করেছি। চিন্তা করে করে বের করেছি। কিভাবে বের করেছি বলব রাণী মা?
বল।
কালো পিপড়াদের সঙ্গে আমাদের একবার যুদ্ধ হল। আপনার কি মনে আছে রাণী-মা?
মনে আছে। আমার স্মৃতিশক্তি ভাল, পিপলী বেগম। আমার স্মৃতিশক্তি খুবই ভাল। আমার সবকিছু মনে থাকে। আমি কিছুই ভুলি না। যুদ্ধের কথা আমার মনে আছে। সেই যুদ্ধে তোমার বাবা কালো পিপড়াদের হাতে বন্দি হয়েছিলেন এই খবরও আমি জানি। তোমার বাবার জন্যে আমার দুঃখ হয়।
কিন্তু রাণী-মা, যুদ্ধ শুরু হবার পর যখন আমাদের অবস্থা খুব খারাপ হল –তখন আরো সৈন্য পাঠানোর জন্যে খবর পাঠানো হল। আপনি বললেন, প্রয়োজন নেই। আমাদের কিন্তু তখনো অনেক অনেক সৈন্য ছিল। আপনি ইচ্ছা করলেই সৈন্য পাঠাতে পারতেন।
আমাকে তো সবকিছু ভাবতে হয় পিপলী। খাবার নিয়ে সামান্য যুদ্ধে যদি আমার সব সৈন্য চলে যায় তাহলে কিভাবে হবে? আমরা কত বিপদ-আপদের মধ্যে বাস করি! আমাদের শক্ত সৈন্যবাহিনী দরকার। তুমি তো জান না, পিপলী, পিপড়াদের সবাই সৈন্য হয় না। যাদের জন্ম হয় মাথায় কাঁটা নিয়ে, তারাই হয় সৈন্য। দশ হাজার ডিম ফুটে বাচ্চা বের হলে দেখা যায় এদের মধ্যে সৈন্য মাত্র বিশ-পঁচিশটা।
হ্যাঁ, তাও ঠিক রাণী-মা। হাজার হাজার ডিম ফুটে বাচ্চা হয়। আপনি নিজে পরীক্ষা করে দেখেন এদের মধ্যে কজন সৈন্য। তাঁদের আপনি বাঁচিয়ে রাখেন। বাকিদের মেরে ফেলেন। এটা কি ঠিক রাণী-মা?
অবশ্যই ঠিক। পিপড়ার রাণী কখনো ভুল কাজ করতে পারে না। ভুল কাজ করার তাদের নিয়ম নেই। সব পিপড়াদের বাঁচিয়ে রাখলে অবস্থা কি হত ভেবে দেখ। পিপড়ার সংখ্যা যেত বেড়ে। এদের কোত্থেকে খাবার দিতাম? এদের বাড়ির ব্যবস্থাই বা কিভাবে করতাম? কাজেই পিপড়ার সংখ্যা বাড়ানো যাবে না।
পিপড়ার সংখ্যা বাড়ানো যাবে না, কিন্তু সৈন্যের সংখ্যা বাড়ানো যাবে। আপনার সৈন্য বাড়ছে –হুঁ হু করে বাড়ছে।
তুমি তো ভুল কথা বললে পিপলী। খুব ভুল কথা। আমার সৈন্য তো বাড়ছে। আমাদের সৈন্য বাড়ছে। ঐ সৈন্যরা, তুমি যখন বিপদে পড়বে, তখন তোমার পাশে দাঁড়াবে।
তা কিন্তু রাণী-মা দাঁড়ায় নি। আমাদের শত শত কর্মী পিপড়া কালোদের হাতে ধরা পড়ল। আমরা দল বেঁধে ছুটে গেলাম আপনার কাছে। আপনি আমাদের সঙ্গে দেখাও করেন নি।
রাণীর নিয়ম তুমি জান না পিপলী। রাণী শুধু তাকেই দেখা দেন, যাকে তিনি ডেকে পাঠান। তোমাকে আমি ডেকে পাঠিয়েছি বলেই দেখা দিয়েছি। তোমার কি আরো কিছু বলার আছে?
আছে।
বল, আমি শুনছি। আমি খুব মন দিয়ে তোমার কথা শুনছি।
আবারো কালো পিপড়াদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ হচ্ছে। আপনি সৈন্য পাঠান নি। আপনি সাধারণ পিপড়াদের পাঠিয়েছেন। এরা যুদ্ধ করতে জানে না। এরা যাচ্ছে আর মারা যাচ্ছে।
মৃত্যু খুব স্বাভাবিক ব্যাপার পিপলী। সবাইকে মরতে হয়। মৃত্যু নিয়ে দুঃখ করতে নেই।
আপনার সৈন্যরা যুদ্ধ করবে না?
প্রয়োজন হলেই করবে। প্রয়োজন এখনো হয়নি। পিপলী কথা বলতে বলতে তুমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছ। তুমি কি আরো কিছু খাবে?
না।
আমি কি বলি জান? আমি বলি –কিছু খেয়ে নাও।
রাণী-মা’র ইঙ্গিতে দুটি পিপড়া থালায় করে আরো খাবার নিয়ে এল। নিশা ফুলের মধু। পিপলী খুব আরাম করে খেল। এত ভাল লাগল তার। এবারো ইচ্ছা করল থালাশুদ্ধ খেয়ে ফেলতে। শুধু তাই না –তার নাচতেও ইচ্ছা করল। এই খাবারের মধ্যে কি কিছু আছে –যা খেলে এ রকম হয়? খুব আনন্দ হয়, ভয় কেটে যায়? মনের মধ্যে যেসব লুকানো কথা আছে সেসব বলে ফেলতে ইচ্ছা করে।
রাণী-মা।
বল পিপলী বেগম।
আমার গান গাইতে ইচ্ছা করছে। নাচতে ইচ্ছা করছে।
বেশ তো গান গাও। গান শুনতে আমার খুব ভাল লাগে।
পিপলী বেগম গান ধরল —
ভাল লাগছে ভাল লাগছে।
আমার বড় ভাল লাগছে।
মজা লাগছে মজা লাগছে
আমার বড় মজা লাগছে।
আনন্দ হচ্ছে আনন্দ হচ্ছে।
আমার বড় আনন্দ হচ্ছে।
রাণী মা।
বল পিপলী।
আমাদের বাড়ির খুব অভাব। মাটির অভাবে বাড়ি তৈরী হচ্ছে না। মাটি আনতে হয় অনেক দূর থেকে। পথে পথে বিপদ। শত শত পিপড়া মাটি আনতে গিয়ে মারা পড়ে রাণী-মা।
যে কোন কাজেই বিপদ আছে পিপলী।
খুব কাছেই এক জায়গায় মাটি পাওয়া গিয়েছিল রাণী-মা। অনুসন্ধানী পিপড়া খুব ভাল মাটির খোঁজ এনেছিল। বাড়ি তৈরির এত ভাল মাটি না-কি হয় না। আপনি সে মাটি পছন্দ করেন নি। আপনি চেয়েছেন –দূরের জায়গা থেকে মাটি আনতে।
হ্যাঁ, তা চেয়েছি। দূরের মাটির খুব সুন্দর গন্ধ। আমি সুঘ্রাণ পছন্দ করি।
আমার কিন্তু অন্য কথা মনে হয়। আমার কি মনে হয় জানেন রাণী-মা –আমার মনে হয় আপনি সবাইকে দূরের পথে পাঠান যাতে তারা মারা পড়ে। কারণ আপনি পিপড়ার সংখ্যা কমাতে চান।
তোমার বুদ্ধি ভাল পিপলী। আসলেই আমি পিপড়ার সংখ্যা কমাতে চাই। আমরা সংখ্যায় কম থাকলে আমাদের খাদ্যের অভাব হবে না। রাণীকে অনেক কিছু ভাবতে হয় পিপলী। অনেক কিছু।
আপনি অনেক কিছু ভাবেন না। আপনি শুধু নিজের কথাই ভাবেন।