জয়গুন হয়তো সহ্য করত। কিন্তু করিম বক্শ তাকে সে সুযোগ দেয়নি।
বছর দুই আগে করিম বক্শ আবার বিয়ে করেছে। তবে আঞ্জুমনের কপাল ভালো। আগের সে মেজাজ আর নেই। বিশেষ করে পয়লা ঘরের ছেলে রহিম বক্শ বাপের অত্যাচারে শ্বশুর বাড়ী উঠে যাওয়ার পর, তার মেজাজ অনেকটা স্তিমিত হয়ে গেছে।
কিন্তু বাহুবল যত কমেছে, বাক্যবল তত নয়। ঝগড়া আর প্যানপ্যানিটাই আজকাল আছে। প্রতিপক্ষ ঝগড়ায় পিছপাও নয় বলে, খেতে বসতে ঝগড়া হয়। দিন বড় বাদ যায় না। যে দিন বাদ যায়, সেদিন পাড়ার সবাই সচকিত হয়। একজন আরেক জনকে জিজ্ঞেস করে—করিম বক্শ বুঝি বাড়ীতে নাই আইজ?
সেদিন আঞ্জুমন এক বেদেনীর কাছ থেকে মেয়ের অসুখের জন্য কিসের তাবিজ রাখছিল! করিম বক্শ হাট থেকে এসে দেখেই আগুন। জিজ্ঞেস করে—কিয়ের তাবিজ, আঁ? আমারে টোনা করবি নি?
তার এই এক অকারণ সন্দেহ।
আঞ্জুমন রেগে যায়, বলে–হ, টোনা করমু। ভেড়া বানাইয়া রাখমু তোমারে।
—হারামী! বৈতাল মাগি! বলে সে উঁচু করে পুরানো লাঠিটা।
—আত উডাইও না কইতে আছি। খইয়া পড়ব আত। কুড়-কুষ্ঠ অইব।
করিম বক্শ লাঠিটা নামায়। তারপর বলে—জয়গুন তো তোর মতন আছিল না। মাইর্যা চাবড়া কইরা ফেলাইলেও উই করত না। আর তোর গায়ে ফুলের টোহা না দিতেই–
জয়গুনকে ছেড়ে দেয়ার পর কাসুকে নিয়ে করিম বক্শ বিব্রত হয়েছিল। একদিন করিম বকশের এক নিঃসন্তান বোন এসে কাসুকে নিয়ে যাওয়ায় সে নিশ্চিন্ত হয়।
কাসু ফুপুর বাড়ীতে এক রকম ভালোই ছিল।
কিছুদিন আগে ফুপু মারা যাওয়ার পর করিম বক্শ তাকে নিজের বাড়ী নিয়ে এসেছে। কিন্তু এ বাড়ীর ঝগড়াটে আবহাওয়ায় এসে কয়েক দিনেই সে মনমরা হয়ে গেছে। এখানে আদর করে কেউ কোলে নেয় না তাকে। ডাকেও না কেউ। এখানে কারো মুখেই হাসি নেই। তাই ওর নিজের হাসিও কোথায় মিলিয়ে গেছে। কারো মুখের দিকে চেয়েই সে ভরসা পায় না। শুধু একজনকেই তার পছন্দ হয়েছে। সে হাসু। তার এখানে আসবার পর সে তিনদিন এসেছে। কিছুদিন ধরে তারও দেখা নেই।
হাসুর দেওয়া কদমা করিম বক্শ পানিতে ফেলে দিয়েছিল। চরকিটা ভেঙে দিয়েছিল পায়ের তলায় ফেলে। কাসুকেও থাপ্পড় মেরেছিল পিঠের ওপর। ঐ দিন থেকেই কাসু আরো মুষড়ে পড়ে। করিম বক্শ সেদিন তাকে একটা মাটির ঘোড়া কিনে দিয়েছিল! কাসু তা ছোঁয়নি।
হাসু আর আসবে না, তার ছোট মনেই সে অনুমান করেছিল সেদিন। হাসুর আসার পথের দিকে চেয়ে তার দীর্ঘশ্বাস পড়ে।
করিম বক্শ ঐ দিন থেকেই হুঁশিয়ার হয়েছে। হাসুকে তার সন্দেহ হয়। ছোঁড়াটা ভারী ফেরেববাজ। ফুসলি দিয়ে কাসুকে নিয়ে যেতে পারে এই তার ভয়। তাই সে যেখানে যায়, প্রায় সাথে সাথেই রাখে কাসুকে। বড় ছেলেটা শ্বশুর বাড়ী পালিয়েছে। কাসুই এখন একমাত্র ভরসা।
খেত-পাথারে জোয়ারের পানি আসার সাথে সাথে করিম বক্শের মনে আসে এক জোয়ার। নাওয়া-খাওয়া ভুলে সে কোঁচ নিয়ে ঘুরে বেড়ায় মাঠে মাঠে! তার ঐ এক ঝোঁক। তার যৌবনের হিংস্র স্বভাবের অবশিষ্ট এই মাছ শিকার। কয়েকদিনের চেষ্টাও অনেক সময় বিফলে যায়। তবু তার ধৈর্যের অভাব নেই। রোদ-বৃষ্টি মাথায় করে সে ধান খেতের ভেতর মাছের সন্ধান করে বেড়ায়।
এ বছর তার সুবিধা হয়েছে আরো। আউশ ধান পেয়েছে মণ সাতেক। এ ধানে প্রায় আমন ধর ধর হবে। কারণ ছেলে ও ছেলেবৌ চলে যাওয়ায় খাবার লোক কমেছে। গাই দুই সের দুধ দেয়। আট আনা করে রোজ একটাকা পাওয়া যায়। সুতরাং তার আর ভাবনা নেই। সারাদিনে সে শুধু বাজারে গিয়ে দুধ বেচে! কাজ আরো আছে বটে। কিন্তু মাছ ধরার নেশায় সে সব কাজের খেয়ালই হয় না। ছেলে থাকতে সব কাজ সে-ই করত।
তিনদিন অবিরাম বৃষ্টিপাতের পর আজ দুপুরের দিকে রোদ উঠেছে। ভাত খাওয়ার পর করিম বক্শ ডাকে—ফুলির মা, এক ছিলিম তামাক দাও দেহি জলদি। বাতাসের রাগ নাই আইজ। মাছ দ্যাখতে সুবিধা অইব।
আঞ্জুমন কয়ে আগুন দিয়ে ফু দিতে দিতে আসে। করিম বকশের হাতের কোটায় কঙ্কেটা বসিয়ে দিয়ে বলে—আর তো কাম নাই তোমার। পাডের জাগডা দ্যাখছ?
—হুঁ, দেখমু হনে আইজ। নিরাগ বাতাসে আইজ চকে যা মাছ দ্যাহা যাইব! —
বাটনা বাইট্টা রাহুম হে-অইলে, কি কও?
করিম বক্শ খোঁচাটা নীরবে সহ্য করে। মাছ সে চার-পাঁচ দিনেও একটা পায় না। তাই এ টিটকারী।
কোঁচ-যুতি হাতে সে নৌকায় ওঠে। পাশের বাড়ীর হারুনকে ডেকে নেয় নৌকা বাইতে। কাসুকেও রেখে যায় না বাড়ীতে।
এদিকের পানি কালো, তাই স্বচ্ছ। মাছ মারতে অসুবিধা। শিকারী মাছ দেখবার আগেই, মাছ শিকারীকে দেখতে পেয়ে পালায়।
দাড়া-পথ বেয়ে তারা খালের ধারের একটা ধান খেতে ওঠে। নদীর পানি খাল দিয়ে। এসে এখানকার পানি ঘোলা করে রাখে।
করিম বক্শ নিশ্চুপ ওঁত পেতে থাকে। চারিদিকে চোখ বুলায় একটা ধান গাছ নড়ে কিনা। কখনও কোঁচ নিয়ে, কখনও যুতি হাতে নিয়ে সে তাক করে।
মাছের কোন লক্ষণ না পেয়ে হাতের ইশারায় সে আর এক খেতের দিকে নৌকা চলাবার নির্দেশ দেয়।
এক জায়গায় কয়েকটা ধান গাছ নড়ে ওঠে। আর যায় কোথা! ঝররর ঝপ! কোঁচ দিয়ে কোপ দেয় করিম বক্শ।
আরো অনেক লোক জমা হয়েছিল মাছ মারতে। একজন বলে আইজ আর মিয়াবাই খালি আতে যাইব না, বোঝতে পারছি।
করিম বক্শ কোঁচটা তুলে নিরাশ হয়। বলে—দুশশালা! আইজ যাত্রাডাই খারাপ। আর কেওর কোঁচের নিচে পড়তে পারলি না? আমারডার নিচেই–