বাজারে এসে তিনজনে তিন রকমের চাল কেনে তারা। কিন্তু একই দরের—টাকায়। আড়াই সের করে।
তারপর বাজার থেকে বেরিয়ে তারা গাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম করে। ফিরে যাওয়ার গাভী আবার বিকেল চারটায়।
গাড়ীর সময় আন্দাজ করে তারা ওঠে। রওয়ানা দেয়ার আগে তিনটা বুলির চাল মিশিয়ে ছয়টা ঝুলির মধ্যে ভরে। ঝুলিতে এক রকমের অনেক চাল দেখলে রেল-বাবুরা সন্দেহ করে, টিকেট চায়। এ রকম করে মিশিয়ে ভিক্ষার চাল বলে চালিয়ে দেয় তারা। টিকেটও লাগে না।
গেদিকে স্টেশনের বাইরে তিনটা বালির পাহারায় রেখে তারা তিনজন তিনটা ঝুলি হাতে স্টেশনে আসে। কিন্তু সদর দরজা দিয়ে নয়, রেলের লাইন ধরে ধরে। টিকেট কালেক্টরকে এড়িয়েই যেতে চায় সব সময়। কিন্তু এত সাবধানতা সত্ত্বেও বাকী তিনটে ঝুলি নিয়ে আসার সময় প্ল্যাটফরমে রেল পুলিশ তাদের আটকায়। বলে—দেখি, দেখি।
সকলের মুখ শুকিয়ে যায়। লালুর মা বলে—ভিক্কার চাউল।
সেপাই চাল দেখে বিজ্ঞের মত মাথা নেড়ে বলে ভিক্ক্যার চাওয়াল, এতনা! হামি কুছু বোঝে না! চল্ থানামে। জানতি নেহি এক জিল্লাকা চাওয়াল দুসরা জিন্নামে যানে হুকম নেহি আছে?
লালুর মা সাহসী। বলে—ছাইড়া দাও, সিপাইজী।
সেপাই বলে—তব্ আয় হামার ছঙ্গে।
প্ল্যাটফরম থেকে দূরে গিয়ে সেপাই প্যান্টের বিরাট পকেট খুলে ধরে। বলে—দে হামার পাকিট ভরদে। রেশন মে চাওয়াল মিলতে আছে না, খালি খুদ।
লালুর মা তিনটা ঝুলির থেকে মুঠ ভরে আধ সের খানেক চাল সেপাইর দুই পকেটে ঢেলে দেয়। সেপাই এবার ছেড়ে দেয়।
জয়গুন পরিশ্রান্ত, ট্রেনের দুলানিতে ঝিমুনি আসে। কাঠের সাথে মাথা ঠেকিয়ে সে ঘুমিয়েই পড়ে। গাড়ী গেন্ডারিয়া স্টেশন ছাড়লে গেদির মার ধাক্কায় তার ঘুম ভাঙে।
তাড়াতাড়ি তারা ঝুলিগুলোর মুখ দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাধে। ট্রেনের হুইসল বাজে। ফতুল্লা স্টেশন এসে যাবে এক্ষুণি। তারা ঝুলি হাতে জানালা দিয়ে মুখ বাড়ায়! হাসু কোষাটা পানি থেকে তুলে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। নির্ধারিত স্থানে কুল গাছটার কাছে গাড়ী আসতেই তারা সবক’টি ঝুলি জানালা দিয়ে দুপদাপ বাইরে ফেলে দেয়।
ফতুল্লা স্টেশনে নেমে তারা কুলগাছতলায় আসে। হাসু ঝুলিগুলো কুড়িয়ে জড়ো করেছে। এক জায়াগায়। মা-কে দেখে বলে—আইজ গাড়ী বড় দেরী করল, মা? বেইল ঘরে যায় যায়, এমুন সময় আমি আইছি।
-কই আর এমুন দেরী?
জয়গুন ঘুমিয়ে পড়েছিল বলে সময়ের টের পায়নি। আটটা বেজে গেছে অনেকক্ষণ।
–কি দর আনলা মা চাউল?
—আড়াই সের ভাও। কিন্তুক দর যেন চড়া চড়া ঠেলরে। তুই কত পালি, বাজান?
—বার আনা। আমি কিন্তু দুই পয়সার চিনাবাদাম খাইছি, মা। এই কয়ড়া আলছি মায়মুনের লাইগা।
জগনের মন প্রসন্ন হয় ছেলের ওপর। সে বলে—জলদি কইর্যা চল, যাই।
০৫. বয়সের সাথে সাথে মানুষের মেজাজ
বয়সের সাথে সাথে মানুষের মেজাজ পরিবর্তন হয়। পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে করিম বকশের মেজাজ ঠাণ্ডা না হলেও কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছে বৈকি। তা না হলে তার শড়কির হাতল ঘুণে ধরতে পায়? চার বছর বোধ হয় লাঠিটায়ও তেল মাজা হয়নি। তেলের দামও বেড়েছে, আর লাঠির দরকারটাও কমেছে অনেক। মাটির ওপর পুরানো লাঠিটা ঠুকতে ঠুকতে তার নিজের ও লাঠির বিগত শৌর্যের কথা মনে পড়ে। পেতলে মুঠি-বাধা এই লাঠিটা যৌবন-কাল থেকেই তার পথচলার সাথী। কারণ, মেজাজের জন্যে শত্রু কম ছিল না তার। তাই বুড়োর মত লাঠি হাতে সে চলত। এমন কি ঘুমোবার সময় পাশেই থাকত লাঠিটা। লাঠিটা হাতে নিলেই তার একদিনের কথা মনে পড়ে।
দুপুর রাত্রে যাত্রাগান শুনে এসেছিল সে। মেহেরনের দরজা খুলে দিতে দেরী হয়েছিল। তাকে হাতের এই লাঠিটা দিয়েই সে মেরেছিল। গর্ভবতী মেহেরন সে আঘাত সহ্য করতে পারেনি। তারপর গলায় রশি বেঁধে গাবগাছে লটকিয়ে সে রেহাই পেয়েছিল। হাজারখানেক টাকা অবশ্য খরচ করতে হয়েছিল এ-ব্যাপারে।
তার আরো মনে হয় আজকাল, লাঠিটা হয়তো হাশরের দিন তার বিরুদ্ধেই সাক্ষী দেবে খোদার কাছে।
মেহেরন করিম বকশের প্রথম স্ত্রী।
তারপর সে জয়গুনকে বিয়ে করে। তার ওপরও তার বাহুবলের কসরত চলে ছয় বছর। তার শরীরের কোনো অঙ্গ বোধ হয় তার প্রহারের কাছে রেহাই পায়নি।
জয়গুনের শাশুড়ী সান্ত্বনা দিত—ওয়াতে কি অইছে বউ! মরদগুনে যেই পিডে মারব, হেই পিড বিস্তে যাইব। যেই আতে, যেই পায় মারব, বেবাক বিস্তে যাইব। তুই বুঝিন কাডুরিয়ার বউর কিচ্ছা হোনস নাই? তয় হোন : রসুল-করিম একদিন বিবি ফাতেমারে কইল-”অমুক জাগায় এক কাডুরিয়া থাকে। তার বউ আট বিস্তের বড় বিস্তে যাইব।” বিবি ফাতেমা জিগাইল—”ক্যান যাইব?” রসুল করিম কইল—”যাও, গিয়া দেইখ্যা আহ একদিন।” বিবি ফাতেমা কাডুরিয়ার বাড়ী গিয়া দ্যাহে কি, ওমা! ঘরের দুয়ারে হাজাইয়া থুইছে দাও, লাডি, ঠ্যাঙ্গা, দড়ি। বিবি ফাতেমা কাডুরিয়ার বউরে জিগাইল—”অত লাঠি ঠ্যাঙ্গা এমুন কইর্যা রাখছে কে?” সে জ’ব দিল—”আমি।” জিগাইল, “ক্যাঁ?” সে জব দিল—”যদি সোয়ামীর খেডমতে তিরুডি অয়, তয় এই লাঠি দিয়া আমারে পিডাইব। কামের সময় কোতায় লাডি বিচরাইব? এই এর লাইগ্যা আতের কাছে আইন্যা রাখছি। জিগাইল, “দাও রাখছ ক্যাঁ?” জব দিল—”যদি মনে লয় কাটব।”
—দ্যাখ, কেমুন জননা আছিল। জয়গুনের শাশড়ী মাথা নাড়ত।
জয়গুন এ কেচ্ছা বহু আগেই শুনেছে। মুসলমান ঘরের বউ এ কেচ্ছা শোনেনি, তা অস্বাভাবিক।