—তুমি কি ফ্যালাইয়া দিতে কও মাইয়াডারে! গেদির মা রুষ্ট হয়ে বলে।
—না, না, হেইডা কইমু ক্যাঁ? কইছিলাম তোর কষ্ট দেইক্যা।
—কষ্ট অইলে আর কি করমু বইন? অদিষ্টে কষ্ট থাকলে খণ্ডাইব কে?
—এক কাম কর না? মাইয়াডার বিয়া দিয়া দে!
—মোডে পাঁচ বচ্ছর বয়স। এত শিগগিরেই!
—এই আর কি এমুন? মাইয়াডাও খাইতে লইতে পারব, তুইও নিভাবনায় থাকবি।
জয়গুন রাস্তাঘাটে সংকুচিত হয়ে থাকে। সে কথা বড় কয় না। এখনও লজ্জাকে সে জয় করে উঠতে পারে নি। তার কান অন্য দিকে। ওপাশে আলোচনা হচ্ছে—দেশ স্বাধীন হবে, চাল সস্তা হবে, এই সব।
চার-পাঁচজন যাত্রীর মধ্যে তখন আলোচনা বেশ জমে উঠেছে। জনকয়েক একটা বাংলা খবরের কাগজের দিকে ঝুঁকে আছে। বাকী সবাই শুনছে ওপাশের আলোচনা।
একজন বলে—এই বচ্ছর আহালের নমুনা দেহা যায়। চাউলের দর একই চোডে আটতিরিশ অইছে।
আর একজন সায় দিয়ে বলে—আহাল অইব না আবার! মানুষ কি আর মানুষ আছে? পাপের ডুইবা গেছে দ্যাশ। দেইক্যে মিয়ার আধা মানুষ মইরা যাইব এই বার। পাপ, পাপে বাপেরেও ছাড়ে না।
অন্য একজন বলে—পঞ্চাশ সনের চাইয়া বড় আহাল অইব এই বার।
একজন প্রতিবাদ করেনা মিয়া, দ্যাশ স্বাদীন অইব। আর দুখু থাকব না কারুর, হুনছি আমি। স্বাদীন আইলে চাউলও হস্তা অইব। আগের মত ট্যাকায় দশ সের।
—ও মশাই আপনের খবরিয়া কাগজে কি লেখছে? জোরে জোরে পড়েন না, হুনি।
যে লোকটি খবরের কাগজ পড়ছিল, সে জোরে পড়তে আরম্ভ করে, ১৫ই আগস্টের মধ্যে ভারতবাসীর হস্তে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হইবে–
—ও মশাই, ওড়া কার ছবি? একজন জিজ্ঞেস করে।
—জিন্নাহ সাবের। খবরের কাগজের পাঠক বলে।
আবার তর্ক। একজন বলে, জিন্না সাবই রাজা অইব। খুব বড় মাথা লোকটার।
অন্য দিক থেকে আর একজন বলে—গান্ধী অইব এই দেশের রাজা।
এ নিয়ে কিছুক্ষণ তর্ক চলে। মাঝ থেকে একজন বলে—সুভাষ বসু থাকলে সে-অই রাজা অইতেন।
—আইচ্ছা মামু, স্বাদীন অইলে খাজনা দিতে অইবনি?
-না, না, খাজনা দিলে আবার স্বাদীন অইল কি?
অপর একজন বলেনা মিয়া, রাজার খাজনা মাপ নাই, দিতেই অইব।
জয়গুন মন দিয়ে শোনে সব কথা। একটি কথাই তার ভালো লাগে, আশা জাগে মনে-চাল সস্তা হবে, কারো কোন কষ্ট থাকবে না।
—হাসুর মা!
জয়গুন তাকায়। লালুর মা বলে—মোখ বুইজ্যা বইয়া আছ যে, এই দিকে কত কি অইয়া গেল।
–কি? উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করে জয়গুন।
—আমার লালুর বিয়া ঠিক কইর্যা ফেললাম। এই দ্যাহো বউ।
লালুর মা গেদিকে আরো কাছে টেনে নেয়।
জয়গুন একটু হাসে শুধু। লালুর মা বলে—বউ কেমন অইব দ্যাখ দেহি।
—ভালা। জয়গুনের সংক্ষিপ্ত উত্তর।
লালুর মা খুশী হয়। সে গদির মা-কে বলে—-গয়নার লাইগ্যা অমন কইর্য না গো। আমি কইছি—কানে কানফুল, নাকে নাকফুল আর বালি, আতে বয়লা, পায়ে ব্যাকখাড়ু দিমু। তয় রূপার দিতে পারতাম না, বইন।
-ওহো, হেইডা অইব না। তুমি বেবাক কেমিকল আর বেলী দিয়া চালাইতে চাও। না বইন, রূপার একপদ জিনিস দিতেই অইব। আর গলার অড়কল আর কোমরের নাবীসঙগ। আমার গাদা মাইয়া। নাবীসঙ্গ না অইলে কেমুন দাহা যাইব।
ঢাকা স্টেশন। লোক নামে, লোক ওঠে। ভিখারীও ওঠে নানা রকমের কানা, খোড়া, বোবা। একজন অন্ধ করুণ সুরে বলে যায়–
যে জন করিবে দান অন্ধ মিসকিনে
বকশিশ পাইবে সেই হাশরের দিনে।।
এক পয়সা যেই দিবে খুশী খোশালিতে।
সত্তুর পয়সা পাইবে আল্লার রহমতে।।
বরকত হইবে তার রুজি-রোজগারে।
বাল-বাচ্চা জিন্দা রবে সুখের সংসারে।।
আ—ল্লা–হ!
অন্ধ হাত পাতে—দ্যান বাবা একটা পয়সা।
একজন যাত্রী বলে—এক পয়সা কি আর আছে বাপু?
মসজিদের চাদার জন্য আসে লোক। রীতিমত বক্তৃতা দিতে আরম্ভ করে–জয়নগর মসজিদের জন্য দান করুন। এর ফল পাবেন কেয়ামতের দিন, পুলসেরাতের দিন। এই টাকায় বেহেস্তে ফুল-বাগিচা হবে, দালান-বালাখানা হবে।
দুএক পয়সা কেউ দেয়, অনেকেই দেয় না। কেউ বলে—এদের এই একটা পেশা।
গাড়ী চলতে আরম্ভ করলে লালুর মা আবার মুখর হয়ে ওঠে—নাবীসঙ্গ দিতে পারতাম না। বিয়াইন, গলার অড়কলও না। তয় খাড়ু না দিয়া পায়ের বুনঝুনি দিমু বউরে, ছোড বউ আমার আঁটব ঝুনঝুন কইর্যা!
জয়গুন ভাবছিল অনেক কিছু। সে নিজের ছেলের বিয়ে দেবে—বউ আসবে ঘরে। মেয়ের বিয়ে দেবে—পরের বাড়ী যাবে সে। লালুর মার শেষ কথায় সে একটু হাসে।
—হে অইলে শাওন মাসের পয়লা দিয়া-অই বিয়া অইব। কি কও বিয়াইন?
গেদির মা একটু চিন্তা করে বলে—ওহো, শাওন মাস আমার মাইয়ার জর্মমাস।
—হে অইলে পরের মাসে?
—পরের মাসে? না না। ভাদ্র মাসে বিলাই পার করে না ঘরতন। আর আমি বুঝিন। মাইয়া পার করুম? কী যে তোমার আক্কল!
—সত্য অইত। আমার মনেই আছিল না ভাদ্র মাস। হে অইলে পরের মাসেই অইব, কেমুন গো?
গেদির মা রাজী হয়।
একটা ছেলে সুর করে বলে যাচ্ছে–
খেয়ে যান মজার নাশতা,
নিয়ে যান সস্তা সস্তা,
এক আনায় দুই বস্তা।
ছেলেটার ছড়া বলার ভঙ্গী আর বস্তার বিরাটত্ব দেখে যাত্রীরা সব হো-হো করে হেসে ওঠে। কেউ কেউ দু’একটা প্যাকেট কিনে চানাচুরের মজাটাও পরখ করে। লালুর মা দুই পয়সা দিয়ে একটা প্যাকেট কিনে ভাবী বউকে দেয়। গেদি খুশী হয়।
একটা বেজে গেছে অনেকক্ষণ। গাড়ী একটা স্টেশনে থামতেই জয়গুন, লালুর মা ও গেদির মা নেমে পড়ে। ময়লা কাপড়ে ভিখারী ভেবে টিকেট কালেক্টর দেখেও দেখে না। এখান থেকে বাজার কিছু দূরে, প্রায় এক মাইল। লালুর মা তার বউকে কোলে করে নিয়ে বেয়ানকে সাহায্য করে।