মায়মুন মুখ কালো করে দূরে সরে যায়। হাসু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েই থাকে।
জয়গুন আবার বলে—আণ্ডা কই?
—জুম্মার ঘরে দিয়া দিছি। বলেই হাসু শিউরে ওঠে।
–জুম্মার ঘরে! তুমি বুঝছ, আমি কিছুই জানমু না? মোড়ল বাড়ীর তন বেবাক হুইন্যা আইছি। হুজুর ফিরাইয়া দিছেন আণ্ডা।
হাসুর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। চাপে পড়ে সত্য কথাটাই বলে সে-–বেইচ্যা ফ্যালাইছি।
–পয়সা দে।
–চুড়ি কিনছি, পয়সা রাহনের জালি আর—
জয়গুন এবার বেরিয়ে আসে বাঘিনীর মত।
—আর কাসুর লাইগ্যা চরকি আর কদ্মা।
বাঘিনীর তেজ মিলিয়ে যায় শুধু একটা নামে। কি মধুর নাম! কাসু! রাগের মাঝে বাৎসল্যের হঠাৎ আবির্ভাব সে সহ্য করতে পারে না। সরে যায় সেখান থেকে।
খাওয়ার সময় আবার তাদের কথা হয়। মা বলে-কাসু কতহানি ডাঙর অইছে রে?
—মায়মুনের মত অত বড় অইছে।
একটা নিশ্বাস বেরিয়ে আসে। হাসু ও মায়মুন চকিত হয়ে মার দিকে চায়। হাসু এবার অন্য কথা পাড়ে-তুমি আর বাইরে যাইও না, মা। মাইনষে কত কতা কয়, বেপর্দা–
ছেলের পাকামি দেখে জয়গুন ধমক দেয়—বাইরে যাইমু না! ঘরে আইন্যা কে মোখের উপর তুইল্যা দিব?
—আমি যা পাই। না পাইলে না খাইয়া মইরা যাইমু। হেই অ ভালা, ত মাইনষের কত আর সয় না।
হাসু সারাদিনে দশ বারো আনা পায় মোট বয়ে। এ দিয়ে তিনটি প্রাণীর এক বেলাও চলে না। জয়গুন বাধ্য হয়েই ঘরের বার হয়েছে আজ অনেক দিন। সে বাড়ী বাড়ী ঘর লেপে, ধান ভানে, চিড়া কোটে। সস্তায় চাল কিনতে যায় উত্তরে। গাড়ীতে করে যায়, ভাড়া লাগে না। গায়ের লোকের কথায় তার গা জ্বালা করে। তাদের নিষেধ মেনে চললে না খেয়ে শুকিয়ে মরতে হবে, সে জানে।
জয়গুন এবার বলে—খাইট্যা খাইমু। কেওরড়া চুরি কইর্যাও খাই না, খ’রাত কইরাও খাই না। কউক না, যার মনে যা’—
কঠিন তার কণ্ঠস্বর।
কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হয়—সে খোদার কাছে পাপ করছে। বাড়ীর বার হয়ে খোলা রাস্তায় সে পুরুষদের মাঝ দিয়ে হেঁটে বেড়ায়। গাড়ীতে কত বেগানা মানুষের মাঝে বসে সে চলে। বেপর্দা মেয়েলোকের কি আজাব হয়, সে জানে। তার প্রথম স্বামী-হাসুর বাপ মুনশী ছিল। পুঁথি পড়ে শোনাত দোজখের শাস্তির বিবরণ। পুঁথির কয়েকটা লাইন তার আজো মনে পড়ে–
মুখের ছুরত যার পুরুষে দেখিবে,
বিছা, বিচ্ছু, জোঁকে তারে বেড়িয়া ধরিবে।
যে চুল দেখিবে তার পুরুষ অচিন,
সাপ হইয়া দংশিবে হাশরের দিন।
যে নারী দেখিবে পর-পুরুষের মুখ,
শকুনি গিরধিনী খাবে ঠোকরাইয়া চোখ।
জয়গুন শিউরে ওঠে। সাপ, বিছা, জোঁক …! তার প্রথম স্বামীর মুখখানাও মনে পড়ে যায়। কী সুন্দর চাপদাড়ি-শোভিত মুখখানা জব্বর মুনশীর। বেহেস্ত-দোজখের কত কথাই সে বলত! বেহেস্তে কত সুখ! আর দোজখ! দোজখের নামে আর একবার আঁতকে ওঠে সে। তার বিশ্বাস, হাশরের দিন জব্বর মুনশী কিছুতেই তাকে তার বেপর্দার জন্য নিজের স্ত্রী বলে স্বীকার করবে না।
তারপর তার মনে পড়ে করিম বশের কথা। জব্বর মুনশীর মৃত্যুর পর জয়গুন তার মান-ইজ্জতের ভার দিয়েছিল তার ওপর। কিন্তু সে তা রাখতে পারেনি। দুর্ভিক্ষের বছর বিনা দোষে সে জয়গুনকে তালাক দেয়।
পুত্র সে হাতের লাঠি বংশের চেরাগ।
কন্যা সে মাথার বোঝা কুলে দেয় দাগ।
সমাজের এই নীতি-নির্দেশে তিন বছরের ছেলে কাসু রয়ে গেল করিম বকশের কাছে। আর মায়মুন ও কোলের মেয়েটির পরিত্যক্তা মায়ের কোল ছাড়া আর কোথাও আশ্রয় রইলো না।
কোলের মেয়েটি দুর্ভিক্ষের বছর মারা যায়।
হাসু ও মায়মুনকে নিয়ে ভেসেই চলছিল জয়গুন। কিন্তু নিজের চেষ্টায় অকুল পাথারে কূল সে পায়। লজ্জাশরম বিসর্জন দিয়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাজে। তাকে বাঁচতে হবে, ছেলেমেয়েদের বাঁচাতে হবে—এই সঙ্কল্প নিয়ে আকালের সাথে পাঁচ বছর সে লড়াই করে আসছে।
আরো অনেক কিছু ভাবছিল জয়গুন। ছেলের ডাকে তার ধ্যান ভেঙে যায়।
—তুমি খাও না, মা?
ছেলেমেয়ের মুখের দিকে চেয়ে মমতায় তার বুক ভরে ওঠে।
দুটি কচি মুখ। এদের বাঁচাতেই হবে। ধর্মের অনুশাসন সে ভুলে যায় এক মুহূর্তে। জীবনধারণের কাছে ধর্মের বারণ তুচ্ছ হয়ে যায়, মিথ্যে হয়ে যায় তার কাছে।
০৪. রেল-রাস্তার ধারে
রেল-রাস্তার ধারে মা-কে নামিয়ে দিয়ে হাসু কোষা ডুবিয়ে রাখে। কেউ নিয়ে যেতে পারে। এই ভয়ে সে তার ওপর কচুরি ঢাকা দিয়ে রাখে। এ ব্যাপারে খুবই হুঁশিয়ার সে। কারণ, বর্ষার দিনে কোষাটা তাদের চলাফেরার একমাত্র সম্বল।
হাসু গাড়ীর দেরী বুঝে রেল-রাস্তা ধরে দক্ষিণমুখি পথ নেয় নারায়ণগঞ্জের দিকে। রেল ও স্টীমারের বড় স্টেশন সেখানে। আজ তিন মাইল রাস্তা হেঁটেই যেতে হবে। আর সব দিন গাড়ীর পা-দানের ওপর দাঁড়িয়ে হাতল ধরে দিব্যি এতটা রাস্তা সে পার হয়ে যায়।
জয়গুন ফতুল্লা স্টেশনে এসে দাঁড়ায়। ট্রেন আসার অনেক দেরী। সে এদিক ওদিক খুঁজে দুজন সাথী যোগাড় করে নেয়।
নয়টার ট্রেন আসে দশটারও পরে। এখানে এক মিনিটের বেশী দাঁড়ায় না গাড়ী। ভিড়ের মাঝে সঙ্গিনীদের সাহায্যে জয়গুন কোনো রকমে উঠে পড়ে। মেঝেতে একটু জায়গা নিয়ে থলে বিছিয়ে বসে। জয়গুনের সাথী দুটি—গেদির মা, লালুর মা-ও বসে নিচে। গেদির মা-র সাথে পাঁচ বছরের গেদি। লালুর মা বিরক্ত হয়, বলে—মাইয়াহান বাড়ীতে রাইক্যা আইতে পার না, গেদির মা?
—বাড়ীতে কার কাছে রাহি বইন?
—ভিড়ের মইদ্যে নিজেরই চলন দায়, তুমি আবার–