হাসু ও মায়মুন পাড়াময় ঘুরে শেষে দিয়ে এল ডিম দুটো।
সাতদিন পরে বসবে সোনা চাচীর মুরগী। তার ফুটবে চৌদ্দটা ডিম। তবু সে বলেছিল—দুটো বাচ্চা হলে তাকে একটা দিতে হবে। অনেক কাকুতি-মিনতি করায় শেষ পর্যন্ত সে রাজী হয়েছে।
গ্রামের মসজিদ। জুম্মার নামাজ হচ্ছে। হাসু বাইরে দাঁড়িয়ে দেখে। সব লোক এক সঙ্গে উঠছে, বসছে, সেজদা দিচ্ছে। হাসুর কেমন ভয় হয়। তারও নামাজের বয়স হয়েছে। সে ভাবে- বারো বছরের হলেই তো নামাজ পড়তে হয়।
নামাজ শেষ হলে হাসু গামছায় বাধা ডিম কয়টা নিয়ে এগোয়। একজন নামাজী শিরনি বিলিয়ে দিচ্ছিল সকলের মধ্যে। গামছা খুলে হাসু তার হাতে দিয়ে দেয় ডিম কয়টা।
ইমাম সায়েবের চোখে এড়ায় না। তিনি ডেকে বলেন—নিয়া আস আণ্ডা কয়ডা এদিকে।
কাছে যেতে আবার বলেন-যাও, দিয়া আস গিয়া আমার এখানে। কে দিল হে?
—ঐযে ঐ ছ্যাঁড়া। আঙুল দিয়ে দেখায় সে।
একজন বলে—সূর্য-দীগল বাড়ীর।
আর একজন বলে চিনেন না হুজুর? জব্বর মুন্সীর পোলা।
ইমাম সায়েব চমকে ওঠেন—ও-ওই! তওবা! তওবা! হারাম! হারাম!
তিনি ডিম কয়টার দিকে জনীর নির্দেশ দিয়ে বলেন—নিয়া যাও জলদি আমার কাছ থ্যাইকা। মসজিদের মধ্যে কে আনল এই আণ্ডা?ফিরাইয়া দ্যাও অহুনি। বেপর্দা আওরতের চীজ। ছি! ছি! ছি!—তার চোখে মুখে ঘৃণার তীব্রতা ফুটে ওঠে।
একজন ইজিগাত করে—একলা একলা সে ময়মনসিংহ যায় টেরেনে কইর্যা। কী হিম্মত!
ইমাম সাহেব বলেন—দেখলা মিয়ারা, ইমানদারকে খোদাওদ করিম হারাম থ্যাইকা কি ভাবে হেফাজত করেন।
আর একজন বলে—জব্বর মুন্সী কত পরহেজগার আছিল। খোদার এমন পিয়ারা আছিল। আর তার পরিবার
হাসু রেগে ওঠে মনে মনে। একবার ইচ্ছে হয়—দেয় ছুঁড়ে ডিম কয়টা ইমামের মুখের ওপর। কিন্তু সাহস হয় না। ডিম ক’টা নিয়ে সে বেরিয়ে আসে।
কোষাটাকে সে জোরে বেয়ে নিয়ে যায়। আজ অনেকগুলো ট্রেন ও স্টীমার ফাঁক গেল। দুটোর জাহাজ ধরা চাইই চাই। দুটো মোট পেলেও ছানার কাজ হবে।
দুটোর জাহাজ, আর বিকেল পাঁচটার ট্রেন ধরে সে আসে বাজারে। ডিম চারটে সে বিক্রি করেই ফেলবে। কেন দেবে সে মসজিদে? মা জিজ্ঞেস করলে বলে দেবে, জুম্মার। ঘরে দেয়া হয়েছে।
ডিম ক’টা সাত আনায় বেচে সে পাঁচ আনায় চারগাছা কাচের চুড়ি কেনে মায়মুনের জন্যে, আর নিজের কোমরে পয়সা বেধে রাখবার জালি কেনে একটা। বাকি দু’আনার এক আনায় কোনে একটা চরকি ও এক আনায় চারটে তিলের কদমা।
সন্ধ্যার দিকে সে কোষ ভিড়ায় একটা বাড়ীর ঘাটে। চারদিকে চেয়ে সে চুপিচুপি ডাকে–কাসু, অ-কাসু!
বছর সাতেকের একটি ছোট্ট ছেলে লাফিয়ে এসে ওর গলা জড়িয়ে ধরে। হাসু ওকে কোলে তুলে নেয়। তারপর ওর মুখে একটা কদমা দিয়ে বলে—দ্যাখ, কেমুন মিষ্ট। এই চরকিডাও তোর লাইগ্যা আনছি। দ্যাখ, কেমুন সোন্দর ঘোরে।
কাসু খুশী হয় খুব। হাসু বলে—যাবি তুই আমার লগে? মা তোর লাইগ্যা কত কান্দে দিন-রাইত!
–ক্যার মা?
—তোর মা। আমার মা।
—হুঁ, মিছা কথা।
—না বলদ, সত্যই।
মা-র কথা শুনে কাসু যেন কেমন হয়ে যায়। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে। তার চোখ টলটল করে। কাসু কিছু বুঝে উঠতে পারে না। সে জানে, তার মা মরে গেছে। বাপ তো। সেই কথাই বলে সব সময়।
—যাইমু তোমার মা-র কাছে—কাসু বলে।
—আমার মা যে তোর মা অয়, বলদ।
—কে? কেডারে অইহানে? কাসর বাপ করিম বক্শ চিৎকার করে ওঠে। তেড়ে আসে লাঠি হাতে-খাড়া হারামির পয়দা, কানকথা দিতে আইছস আমার পোলারে!
কাসুকে কোল থেকে নামিয়ে বাকী কদমা তিনটে ওর হাতে দিয়ে প্রাণভয়ে দৌড় দেয় হাস। কোটা ঠেলে দিয়ে চড়ে বসে। প্রাণপণে বেয়ে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়।
কাসুর বাপ করিম বক্শ পানির কিনারা পর্যন্ত এসে বাধা পায়। চেঁচিয়ে বলে—আবার এই মাহি পাও বাড়াইলে আড্ডি গুড়া কইর্যা ফ্যালাইমু। মানুষ চিন না বজ্জাতের বাচ্চা!
তারপর এদিক ওদিক চেয়ে কয়েকটা মাটির ডেলা নিয়ে ছুঁড়তে থাকে ওর দিকে। একটা ডেল। এসে হাসুর পিঠের ওপর পড়তেই সে লাফ দিয়ে পানিতে পড়ে যায়। কোষার আবডালে থেকে আত্মরক্ষা করতে থাকে। করিমবক চলে যেতেই কোমায় চড়ে জোরে লগির খোচ দেয়।
কাসুদের বাড়ী থেকে শব্দ শোনা যায়, সাথে সাথে গর্জনও হারামজাদা, কদমা দিয়া ভুলাইতে আইছস। আবার আইলে বাপের মরণ দেহাইয়া ছাইড়্যা দিমু।
আবার শোনা যায়—চরকি! দ্যাখ অহন চরকিবাজি কেমুন লাগে।
হাসুর চোখে পানি আসে। পিঠের ব্যথার কথা ভুলে যায় সে। কাসু যে তারই ভাই, এক মা-র পেটের ভাই। হোক না বাপ ভিন্ন। কিন্তু মা-তো একজনই। সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, সে আর ঐ মুখো হবে না। তার জন্যেই কাসু আজ মার খাচ্ছে।
মোট বয়ে আজ ছ’আন পেয়েছে হাসু। বাড়ী এসেই মা-কে দেয় তিনটে দু’আনি।
মা বলে—এই পাইলি আইজ?
—গেলাম তো দুফরের পর, আরঅ? বলেই হাসু বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। মায়মুনকে ডাকে—দেইকা যা মায়মুন, কি আনছি।
নতুন কিছু দেখবার জন্যে মামুনের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। হাসু চুড়ি চারগাছা ওর হাতে পরিয়ে দেয়। মায়মুনের মুখ আনন্দে ভরে যায়।
জয়গুন বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেয়ে বলে—চুড়ি কিনলি, পয়সা পাইলি কই?
—আইজ পথে যাওনের কালে একটা পোকা পাইয়া গেলাম। আমতা আমতা করে হাসু।
—চুড়ি তোমারে কে কিনতে কইছে? রাগতস্বরে বলে জয়গুন। হাসু কোন উত্তর দেয় না। তার এই চুপ করে থাকাটা জয়গুনকে ক্ষিপ্ত করে তোলে। দাঁত কিড়মিড় করে বলে—খাইতে নাই হইতে রাঙ্গা পাডি। আইজ রাইতে ভাত নাই তোর কপালে।