জয়গুন সুঁই-সুতো নিয়ে কাপড় সেলাই করতে বসে। কাপড়টা অনেক জায়গায় ছিড়ে গেছে। এ কাপড় নিয়ে বেরোবার উপায় নেই। হাসুর গামছা বুকে জড়িয়ে গায়ের আঁচলটা আগে সেলাই করে। সেটা শেষ হলে বাকী আঁচলটা সেলাই করে তারপর।
ভোর হয়। ঘুম থেকে জয়গুন ওঠে নতুন প্রাণ, নতুন উদ্যম নিয়ে।
শফির মা-র কাছ থেকে চাল ধার করে রান্না হয়। ছেলেমেয়েকে খাইয়ে, নিজে খেয়ে জয়গুন বেরিয়ে পড়ে।
ধানখেতের আল ধরে পথ চলে জয়গুন। হাঁটু-সমান উঁচু ধান গাছে ভরা মাঠ। যেন সবুজ দরিয়া। ঝিরঝিরে বাতাস ঢেউ-এর নাচন তোলে। ছড়িয়ে দেয় মাঠের এক প্রান্ত হতে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত। দূরপ্রসারী মাঠের দিকে তাকিয়ে জয়গুনের চোখ জুড়ায়।
খেতের কাজে ব্যস্ত চাষীরা তাকায় জয়গুনের দিকে। কিন্তু তার ভ্রূক্ষেপ নেই। গদু প্রধান তার খেত তদারক করছিল। সকলের অলক্ষ্যে সে মাথা নাড়ে আর বলে—তোরে শাসন করতে পারতাম না! আমার নাম গদু পরধান। এটু সবুর কর।
১৯. সূর্য-দীঘল বাড়ীর ভূত ক্ষেপেছে
সূর্য-দীঘল বাড়ীর ভূত ক্ষেপেছে।
রাতে জয়গুনের ঘরের বেড়া ও চালের ওপর ঢিল পড়তে শুরু করে। হাসু, কাসু ও মায়মুন চিৎকার করে ওঠে, শেষে গলা দিয়ে চিৎকারও বের হয় না। ভয়ে তারা মা-কে জড়িয়ে ধরে।
ওদিকে শফির মা-র চিৎকার শোনা যায়।
পরের দিন ভোরে সে বলে–হেসুম কইছিলাম পাহারা বদলাইতে। অখন দ্যাখ কি দশা অয়! গাছগুলা কাটতে মানা করছিলাম। কোন্ গাছে কি আছিল, কে জানে? ওগ বাসা ভাইঙ্গা দেওনে রাগ অইছে।
পরের রাত্রেও এমনি ঢিল পড়ে। গ্রামে এই নিয়ে হৈচৈ পড়ে গেছে। সূর্য-দীঘল বাড়ীর কাছ দিয়ে আর কেউ হাঁটে না।
গ্রামের বুড়ো সোনাই কাজী বলে—সূর্য-দীগল বাড়ীর ভূত ক্ষেপছে, আর উফায় নাই। সূর্য-দীগল বাড়ীতে মানুষ উজাইতে পারে না, বুড়া-বুড়ীর কাছে হুনছি। সূর্য-দীগল হাটেরও উন্নতি অয় না। আমার চাউথেই দ্যাখলাম, জলধর কুণ্ডু, কুণ্ডেরচরে হাট মিলানোর লেইগ্য কত টাকা খরচ করল। কত হরিলুট দিল। ব্যাপারীগ মিডাই খাওয়াইল, নট্ট কোম্পানীর যাত্রা গানেও দুই এক আজার টাকা খরচ করছিল। কিন্তু কই? হাট আর মিলাইতে পারল না।
থুথুরে বুড়ী হনুফা বিবি বলে আমার মামু একবার সূর্যুদীগল মৌপোকের বাসা ভাঙছিল। আমার মনে আছে। গাছের তন নামতে না নামতে আঁড়ির তলা ভাইঙ্গা মধু পইড়া গেল। কী তেজ! বাপ্পুসরে!
জয়গুন ছেলে-মেয়েদের নিয়ে রাত্রে শফির মা-র ঘরে আশ্রয় নেয়। ছেলে-মেয়েদের বুকে নিয়ে সারারাত ‘আল্লা আল্লা’ করে।
অমাবস্যার রাত। করিম বক্শ গালে হাত দিয়ে কুপির সামনে বসে ভাবছে। তার মরে চোখে ভাসে—জয়গুনের ঘরে ঢিল পড়ছে দাডুম-দুড়ুম। তার বুকে কাসু ও মায়মুন ভয়ে মিইয়ে গেছে। হাসু পাশে বসে বসে কাঁপছে চোখ বন্ধ করে। জয়গুন আর একা এদের সামলাতে পারছে না। করিম বশের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সে। তার চোখের অব্যক্ত ভাষায় সে যেন সাহায্য চাইছে তার কাছে।
করিম বক্শ গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। তাকের ওপর থেকে চারটে গজাল নিয়ে গামছায় বাঁধে। জোবেদ আলী ফকিরের নির্দেশমত আজ এই অমাবস্যার দুপুর রাতে সূর্য-দীঘল বাড়ীর চার কোণে মন্ত্রসিদ্ধ গজাল ক’টা পুঁতে আসতে হবে তাকে।
সূর্য-দীঘল বাড়ী ঠিক-ঠাক কারে জোবেদ আলী ফকির সেই যে একটি পেতলের কলসী দাবী করেছিল, আজ পর্যন্ত তাকে দেয়া হয় নি সে কলসী। বছর বছর পাহারা বদলাবার কথাও সে বলেছিল। তাতেও কান দেয়নি জয়গুন ও শফির মা। এ জন্যে গোস্বা হয়ে সে করিম বক্শকে জানিয়েছিল—এইবার দেখুক মজাখান। সাত দিনের মধ্যে বেবাক মিস্মার অইয়া যাইব। করিম বক্শ একটা পেতলের কলসী কিনে দিয়ে এবং অনেক হাতে-পায়ে ধরে জোবেদ আলী ফকিরের রাগ মাটি করেছে।
ফকির গজাল কয়টায় ফুঁ-ফাঁ দিয়ে তুকতাক করে করিম বকশের হাতে দিয়ে বলে-পরশু অমাবইস্যা। রাইত দুফরের পর–। চাইর কোণে চাইড্ডা—
–আমার ডর করে যে! একলা যাইতে সাবাসে কুলায় না। করিম বক্শ বলে।
—ডর করে! কও কি?
একটু চিন্তা করে ফকির বলে—আইচ্ছা, হেই দাওয়াইও আছে। করিম বকশের কাঁধে দুই হাত রেখে ফকির টানা সুরে মন্ত্র পড়ে–
খাটো কাপড় উলট বেশে
বাণ মারলাম হেসে হেসে।
সেই বাণে মেদিনী কাঁপে,
জল কাঁপে, থল কাঁপে,
চান কাঁপে, তারা কাঁপে,
পাতালের বাসুকী কাঁপে,
আগে ভাগে ভূত-পেরেতে,
জিন ভাগে শেষে।
কালা বাণে ভূত মারলাম,
পেত্নী বানলাম কেশে।
মন্ত্র পড়ে করিম বক্শের বুকে ও চোখে সাতবার ফুঁ দিয়ে ফকির এবার বলে-ডরের মাজা ভাইঙ্গা দিছি। যাও এইবার, আর ডর নাই। পরশু রাইত দুফরের পর, মনে থাকে যেন। চাইর কোণায় চাইড্ডা–
চারটি গজাল—বাড়ীর চার পাহারাদার। ঠিক-ঠাকে বসিয়ে আসতে পারলে ভূত-পেত্নীর দৌরাত্ম আর থাকবে না।
কুপি নিবিয়ে করিম বক্শ লাফ দিয়ে ঘর থেকে বেরোয়। সে পা ফেলে জোরে, আরো জোরে। কালো রাত্রির জমাট অন্ধকার যেন ভয় পেয়ে তার চলার পথ ছেড়ে দেয়।
ঈশান ও বায়ু কোণে দুটি গজাল পুঁতে সে পশ্চিম দিকে চলে আসে। ঘন অন্ধকার। তার মাঝেও দৃষ্টি চলে করিম বক্শের।- তিনটা ছায়ামূর্তি! ভয়ে তার গায়ের রোম কাটা দিয়ে ওঠে। সূর্য-দীঘল বাড়ীর তাল গাছের তলায় সে থমকে দাঁড়ায়। কাঁপতে কাঁপতে বসে পরে মাটিতে।
ছায়ামূর্তিগুলো ঢিল ছুঁড়ছে আর তারই দিকে সরে সরে আসছে। করিম বক্শ একটা শব্দহীন চিৎকার করে ওঠে। বার কয়েক টিপটিপ করে যন্ত্রটা যেন বন্ধ হয়ে যায়। একটা মূর্তি আরো কাছে সরে আসে তার। করিম বক্শের গায়ে ধাক্কা লাগে লাগে। এবার করিম বক্শ চিনতে ভুল করে না। হৃদযন্ত্রটা আবার বার দুই ঢিপঢিপ করে চালু হয়ে যায়। হঠাৎ ঘাম দিয়ে তার ভয়ও কেটে যায়। সে দাঁড়ায়। পাশ থেকে খপ করে ছায়ামূর্তির একটা হাত চেপে ধরে- গদু পরধান! তোমার এই কাম!!…!!!