কাসু হাঁড়ির খবর জানে না। জাবার বয়সও তার নয়। তা ছাড়া জানবার মত কোন কারণও জয়গুন ঘটতে দেয়নি আজ পর্যন্ত।
জয়গুন শুনতে পায় নারকেলের আঁইচা বাজিয়ে মায়মুন ও কাসু ঝিঁঝি ধরার ছড়া গাইতে শুরু করেছে?
ঝিঁঝি লো, মাছি লো,
বাঁশতলা তোর বাড়ী,
সোনার টুপি মাথায় দিয়া
রূপার ঝুমুর পায়ে দিয়া
আয়-লো তাড়াতাড়ি।
ঝিঁঝি ঝিঁঝি করে মায়,
ঝিঁঝি গেছে সায়বের নায়,
সাতটা কাউয়ায় দাঁড় বায়,
ঝিঝিলো তুই বাড়ীত আয়।
ঝিঝির বাপ মরছে
কুলা দিয়া ঢাকছে,
ঝিঁঝির মা কানছে,
আয়-লো ঝিঁঝি */বাড়ীত আয়।
কিন্তু এ রকম ফাঁকি দিয়ে আর কত দিন? কাল রাত পোহালেই যখন এক মুঠো ভাত দিতে পারবে না ছেলের মুখে, তখন কি এ অভাবের কথা গোপন থাকবে ছেলের কাছে? ক্ষুধায় অস্থির হয়ে যখন সে ‘ভাত ভাত করে চিৎকার করবে, তখন মা হয়ে কি জবাব দেবে সে? জবাব না পেয়ে সে কি তখন বুঝবে না যে, তার মা অপদার্থ, খেতে দিতে পারে না। জয়গুন ভাবে এসব কথা। এ ভেবে আরো ব্যথিত হয় যে পেট ভরে খেতে দিতে না পারলে কাসুর কাছে তার বুকভরা স্নেহের কোন দামই আর থাকবে না। ছেলের আস্থা থাকবে না মা-র ওপর। মা-র স্নেহের ছায়ায় আসার জন্য একদিন সে অস্থির হয়ে উঠেছিল। এবার ক্ষুধার তাড়নায় করিম বুকশের কাছে ফিরে যাওয়ার জন্যে সে অস্থির হয়ে উঠবে আবার।
সন্ধ্যার পর তিনপো চাল গামছায় বেঁধে হাসু বাড়ী আসে।
জয়গুন চোখ টিপে হাসুকে জিজ্ঞেস করে—মাছ কই হাসু? তোরে না কইছিলাম, ইলশা মাছ আনতে?
হাসু কথার ধরন বুঝতে পেরে বলে—ইলশা কাতলা কোন মাছই পাইলাম না বাজারে। মাছ মোডে নাই।
দু’দিনের না-খাওয়া জয়গুনের বুকের ভেতর ধড়ফড় করে। পেটের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে মাঝে মাঝে, যেন নাড়ি-ভুড়িগুলোও হজম হয়ে যাচ্ছে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। গামছায় বা ধা চাল দেখে তার ক্ষুধা আরো বেড়ে যায়।
জয় গুন সমস্তটা চাল নিয়ে হাঁড়ি বসায় আজ। ভোরের জন্যে রেখে দেয় না কিছুই। এই বেলা খেয়ে কিছু যদি বাঁচে তবে ছেলে-মেয়েরা পান্তা ভাত খেতে পাবে ভোরে। কিন্তু সে আশা কম। তার মনে হয়, একাই সে তিনপো চালের ভাত খেতে পারবে এখন।
কচুর লতির চচ্চড়ি ও ডাটা শাক দিয়ে পরম তৃপ্তির সঙ্গে ভাত খায় সকলে। অনাহারে শুকনো বুকে ভাত ঠেকে জয়গুনের। বাবার পানি খেয়ে সে বুক ভিজিয়ে নেয়।
জয়গুন বলে হাসুকে-কি চাউল রে! ফেনা যে ঘাডের পানি মতন। আবার চুকা। দেইখ্যা আনতে পারস না?
—চাউল পাওয়া যায় না বাজারে, তার আবার দেইখ্যা আনুমু। কত কষ্টে এই চাউল যোগাড় করলাম। বারো ছটাক বারে অনা। কাইল বাজারে ঢোল দিছিল ম্যাজিস্টর সাব—নয় আনার বেশী এক সেরের দাম নিলে জরিমানা অইব। এই-এর লেইগ্যা বাজারে চাউল নাই। মহাজনরা গোলায় গুঁজাইয়া থুইছে চাউল।
খাওয়া শেষে হাঁড়িতে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।
ছেলে-মেয়েরা মুমিয়ে পড়েছে সকাল সকাল। দু’দিনের অনাহারের পর ভাত খেয়ে জয়গুন আরো শ্রান্ত হয়ে পড়েছে। আজ তার শরীর ঝিমঝিম করে। চোখ দিয়ে পানি ঝরে
জয়গুন বসে বসেই এশার নামাজ শেষ করে। প্রতিদিনের মত তসবীহ নিয়ে জপতে আরম্ভ করে। কিন্তু সকাল কাজের মধ্যে ঐ এক চিন্তা–কাল রাত পোহালে ছেলে-মেয়েরা মুখে কী দেবে? হাসু কী খেয়ে কাজে যাবে? কার কাছে কৈফিয়ত দেওয়ার কিছু নেই।
জয়গুনের উত্তরে চাল কিনতে যাওয়ার সাথী লালুর মা দু’দিন এসেছিল। অনেক সাধাসাধি করেছিল ফতুল্লার ধান কলে কাজ করার জন্যে। কিন্তু জয়গুন তওবার কথা ভেলে নি। হাতে পায়ে যে শিকল সে পরেছিল সেদিন, তা খুলবার সাহস তার নেই। শক্তি পায় না। নিতান্ত অসহায়ভাবে সে লালুর মা-র প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আজ লালুর মা-র বলা কয়েকটি কথা বারবার তার মনে আসে। সে বলছিল-না খাইয়া জানেরে কষ্টে দিলে খোদা ব্যাজার সয়। মরলে পরে খোদা জিগাইব, তোর আত-পা ও দিছিলাম কিয়ের লেইগ্যা? আত দিছিলাম খাটবার লেইগ্যা, পাও দিছিলাম বিদ্যাশে গিয়া টাকা রুজি করনের লেইগ্যা।
লালুর মা কথায় কথায় গ্রাম্য গীতের কয়েকটা লাইনও গেয়ে উঠেছিল সেদিনঃ
আত আছিল, পাও আছিল,
আছিল গায়ের জোর,
আবাগী মরল ওরে
বন্দ কইর্যা দোর।
কথাগুলো আজ তার নতুন অর্থ, নতুন ব্যাখ্যা নিয়ে জনের চিন্তাকে নাড়া দেয়। লালুর মা-র প্রস্তাবকে সে বারবার বিবেচনা করে দেখে। ধান কলের কাজ এমন কিছু নয়। ধান ঘাটা, ধান রোদে দেয়া, চাল ঝাড়া—এই সব কাজ। রোজ পাচসিকা করে পাওয়া যায়। তা ছাড়া খুদ-কুড়াও পাওয়া যায় চেয়ে-চিন্তে।
মনের দুই বিরোধী চিন্তার সংঘর্ষের মধ্যে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলে।
মশার কামড় খেয়ে মায়মুন হাত-পা নাড়ছে। জয়গুন তাকায় ঐ দিকে। হাসু বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। সারাদিন খেটে তার আর হুঁশ নেই। মশার কামড়েও তার ঘুমের ব্যাঘাত হয় না। কাসু তার মিয়াভাইর গলা ধরে তার গায়ের ওপর একখানা পা চড়িয়ে দিয়ে ঘুমুচ্ছে। কুপির অস্পষ্ট আলোকে ছেলেমেয়েদের দিকে সে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তাদের কচি মুখ জয়গুনকে তার পথের সন্ধান বাতলে দেয়, তওবার কথা সে ভুলে যায়। লালুর মা-র। প্রস্তাব মাথায় নিয়ে কাল যাবে সে ধান কলে কাজ করতে। হাতে পায়ে তাকত থাকতে কেন সে না খেয়ে মরবে? ক্ষুধার অন্ন যার নেই, তার আবার কিসের পর্দা, কিসের কি? সে বুঝেছে, জীবন রক্ষা করাই ধর্মের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ মূলমন্ত্র। জীবন রক্ষা করতে ধর্মের যে কোন অপ-আক্রমণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে সে প্রস্তুত। উদরের আগুন নিবাতে দোজখের আগুনে ঝাপ দিতেও তার ভয় নেই।