করিম বক্শ দুধের হাঁড়ি মাথায় উঠানে এসে ডাকে–কাসু!
কাসু ততক্ষণে পিছ-দুয়ার দিয়ে পালিয়েছে।
আরো দু-তিন ডাক দিয়েও যখন কাসুর সাড়া পাওয়া যায় না, তখন সে মায়মুনকে ডাকে—একটা ঘড়ি লইয়া আয় মায়মুন।
জয়গুনের একবার বলতে ইচ্ছে হয়—আমরা দুধ খাই না। লইয়া যান দুধ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই বলা হয় না।
মায়মুন ঘটি নিয়ে আসে।
করিম বক্শ এক সের দুধ টিতে ঢেলে দিয়ে বলে—রোজ এমুন সুম আমি দুধ দিয়া যাইমু। আমাগ ধলা গাইড বিয়াইছে। কাসুর ভাগ্যে একটা দামড়ি বাছুর অইছে। বাছুর ঘাস ধরলে কাসুরে দিয়া যাইমু। কাসু কই গেছে রে?
মায়মুন উত্তর দেয়—পালাইছে।
করিম বক্শ আর দাঁড়ায় না। যেতে যেতে একবার পেছনে তাকায়। জয়গুনের চোখে চোখ পড়তে লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
জয়গুন ধমক দেয় মায়মুনকে—দুধ রাখলি, খাইব কে?
—ক্যাঁ? আমরা।
—হ, তোরা-ই খা। আমি ইতাম না ওই দুধ।
সকলকে চমকে দিয়ে টিয়া-ঠুঁটে আম গাছটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে। দু’একটা পাখীর আর্ত চিৎকার ভেসে আসে পাশের ঝোপ থেকে।
নাবিক সিন্দাবাদের ঘাড়ের ওপর এক দৈত্য চেপে বসেছিল। বাঙলা তেরোশ’ পঞ্চাশ সালের ঘাড়েও তেমনি চেপে বসেছিল দুর্ভিক্ষ। হাত-পা শেকলে বাঁধা পরাধীন সে বুভুক্ষু তেরো’শ পঞ্চাশের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে, তার পরের আরো চারটি উত্তরাধিকারীর। কিন্তু দুর্ভিক্ষ আর ঘাড় থেকে নামেনি। ঘাড় বদল করেই চলেছে একভাবে। হাত-পায়ের। বন্ধনমুক্ত স্বাধীন তেরোশ’ পঞ্চান্নে এসেও সে আকাল-দৈত্য তার নির্মম খেলা খেলছে। তাকে আর ঘাড় থেকে নামান যায় না।
দেশে চালের দর কড়ি টাকার নিচে নামে না বছরের কোন সময়েই। ফালগুন মাস থেকে সে দর আরো চড়ে যায়। চড়ে যায় লাফিয়ে লাফিয়ে। চল্লিশ টাকায় গিয়ে ঠেকে। আউশ ধান ওঠার আগে এই দর আর নামে না। ফলে যারা টেনেটুনে দু’বেলা খেত, তারা এক বেলার চালে দু’বেলা চালায়। ফেনটাও বাদ দেয় না, ভাতের সঙ্গে মিশিয়ে দুধ-ভাতের মত করে খায়। যারা দুবেলা আধপেটা খেয়ে থাকত, এ সময়ে তারা শাক-পাতার সাথে অপি চাল দিয়ে জাউ রেধে খায়। মুধিতের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যায়। পেটের জ্বালায় ভিক্ষার ঝলি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে অনেকে। আশা—দশ দুয়ারে মেগে এক দুয়ারে বসে খাবে। কিন্তু দশের দশা শোচনীয়। সমস্ত দেশ দিশেহারা। দুর্ভিক্ষে কে দেয় ভিক্ষে?
এ পৌনঃপুনিক দুর্ভিক্ষ শুধু কি ভাতের? কাপড়েরও। শত কপাল কুটলেও সরকার-নিয়ন্ত্রিত মূলের দ্বিগুণ দিয়েও একখানা কাপড় পাওয়া যায় না। অনেকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ কাটিয়ে দেয় একই কাপড়ে। তালি খেয়ে খেয়ে ময়লা জমে জমে ভারী হয়ে ওঠে সে কাপড়। বৃষ্টি ও ঘামে ভিজে বিদঘুটে বোটকা গন্ধ ছড়ায়।
জয়গুন অনেক ভেবেছে ভাল কাপড়ের ভাবনা। কিন্তু হাত-পা গুটিয়ে ঘরে বসে বসে এ ভাবনার অর্থ নেই, সে হাড়ে হাড়ে বুঝেছে। মায়মুনের বিয়ের সময়, ছমাস আগে তওবা করে সেই যে ঘরে ঢুকেছে, আজ পর্যন্ত সেই তওবারর অমর্যাদা সে করেনি।
—কিন্তু এমনি করেই কি আর দিন চলবে? এমনি করেই কি পেটের জ্বালা জুড়োবে? কাপড় জুটবে পরনের? জয়গুন প্রশ্ন করে নিজেকে।
পেটের জ্বালা এদিকে বেড়েই চলছে দিন দিন। দুই দিন এক রকম কিছুই খাওয়া হয়নি।
কাল রাত্রে খাওয়ার সময় কাসু জিজ্ঞেস করেছিল—তুমি খাইবা না, মা?
—আমি রোজা আছি। তোরা খাইয়া ওঠ। তোর ব্যারামের সময় মানতি করছিলাম তিনড়া রোজা রাখতাম বুইল্যা।
—রাইতেও খাইবা না তুমি? মায়মুন বলে।
—এই রোজায় দিন-রাইত না খাইয়া থাকতে অয়।
কাসু বিশ্বাস করলেও হাসু ও মায়মুন বিশ্বাস করে নি সে কথা। নিজের পাতের কয়েক মুঠো ভাত হাঁড়িতে তুলে রেখে হাসু উঠে গিয়ে বলেছিল—আইজ ভুখ নাই মা।
হাসুর দেখাদেখি মায়মুনও থালার ভাত রেখে বলে–আমারও ভুখ্ নাই। দু’দিনের মধ্যে সে ভাত ক’টাই পেটে দিয়ে আছে জয়গান।
বাড়ীর আমগাছ, তেঁতুলগাছ, কাডের বাঁশ কেটে ছাপ্পোনছাড়া’ করে দেয়া হয়েছে। চারটে ‘আণ্ডালু’ হাস বিক্রি করে দিয়েছে। বিক্রি করবার মত আর কিছুই নেই।
বিকেল হলেই কাসু খেলা ছেড়ে মা-র আঁচল ধরে তার পিছু পিছু ঘুরতে থাকে, তাগিদ দেয়—ভাত রানবা না, মা? আমার ভুখ লাগছে। এই দ্যাই না প্যাটটা কেমুন ছোড অইয়া গেছে।
কাসু হাত দিয়ে পেটটা দেখায়। জয়গুন দেখে, সত্যি পেটটা নেমেই গেছে। সে ফাঁকি দিয়ে বলে—তার মিয়াভাই মাছ আনলে তারপর পাক করমু। নিত্যি নিত্যি শাক পাতা ভাললাগে না।
—কি মাছ, মা? ইলশা মাছ?
—হ, ইলশা মাছ।
কাসু খুশী হয়।
সন্ধ্যা হয়ে আসে। হাসু এখনও এলো না। জয়গুন কাসুকে ভুলিয়ে রাখবার জন্যে মায়মনকে বলে—মায়মন, ওরে লইয়া যা। ঝিঁঝিঁ ধইর্যা দে গিয়া। ঐ দ্যাখ, হেন কেমুন ডাকে।
দুটো নারকেলের আঁইচা যোগাড় করে কাসুকে নিয়ে মায়মুন শফিদের ঘরের ছাঁচতলায় যায়। দু’হাতে আঁইচা দুটো নিয়ে ঠুকতে আরম্ভ করে—ঠর্র্ ঠর্র্।
এ রকম শব্দে ঝিঁঝিঁ পোকা আকৃষ্ট হয়! জঙ্গল থেকে বেরিয়ে শব্দকে কেন্দ্র করে উড়তে থাকে। যখন হাতের কাছের কোন কিছুর উপরে বসে, তখন ধরতে বেগ পেতে হয় না।
নিজের অসামর্থ্যের জন্য অবুঝ ছেলের কাছেও লজ্জিত হয় জয়গুন। পেটের ছেলে, তবুও নিজেদের দৈন্য ঢেকে রাখবার চেষ্টা করে সে সব সময়। হাসু ও মায়মুনকে কম করে খেতে দিলেও কাসুকে খেতে দিতে হয় পুরো। যেন সে অভাবের কথা জানতে না পারে।