করিম বক্শ কাসুকে এনে জয়গুনের ঘরের দরজার ওপর ছেড়ে দেয়। হাসু ও মায়মুন এসে কাসুর হাত ধরে ঘরে নিয়ে যায়। জয়গুন বসে আছে নিশ্চল। চোখের পানি শুকিয়ে তার দুই গালে দুটি রেখা স্পষ্ট হয়ে আছে। জয়গুন কাসুর দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় না, বলেও না কিছু মুখে। কাসু দু’হাত দিয়ে তাকে ধরতেই জয়গুন তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। হাসু ও মায়মুন পাশে বসে কাসুর পিঠে ও মাথায় হাত বুলায়।
উঠানে করিম বক্শ দাঁড়িয়ে আছে। মায়মুনকে উঠানে একখানা পিঁড়ে দিয়ে আসতে বলে জয়গুন।
মায়মুন সসঙ্কোচে পিঁড়ে হাতে বাপের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। করিম বক্শের মমতাহীন লাল চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে। হাত বাড়িয়ে মায়মুনকে ধরতে যায়। কিন্তু তার হাত কাঁপছে কেন? মেহেরনকে হত্যা করার সময় যে হাত কাঁপেনি, মায়মুনসহ জয়গুনকে মেরে তাড়িয়ে দেয়ার সময় যে হাত তার বিচলিত হয় নি, আজ সেই হাত কাঁপছে কেন? সেই হাতের শক্তি কোথায়? নিজের মেয়েকে স্পর্শ করার শক্তিও যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে। মায়মুনকে স্পর্শ করার অধিকার যেন হারিয়েছে সে।
করিম বকশের হাতটা আপনার থেকেই নেমে আসে। মাথা নিচু করে সে বাড়ীর দিকে পথ নেয়।
শফির মা জ্বরের শরীর নিয়ে লাঠি ভর দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে আসে। বলে—আহা, হুকাইয়া এক্কেরে কাষ্ট অইছে মানিক। খালি আড়গুলা আছে।
—আড় বাঁইচ্যা থাকলে মাংস একদিন অইবই। কাসুর চুলে আঙুল চালাতে চালাতে জয়গুন বলে।
—হ, আল্লায় বাঁচাইয়া রাখুক। আমার যত গাছ চুল আছে, তত বচ্ছর আয়ু যেন খোদায় ওরে দ্যায়।
করিম বক্শ এখন রোজ আসে কাসুকে দেখতে। কোনদিন মাঠের মাঝ দিয়ে তাকে আসতে দেখে কাসু আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। ঝোপের আড়ালে বসে থাকে যতক্ষণ না করিম বক্শ চলে যায়। তার ভয়—করিম বক্শ তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্যেই আসে। তার এ বিশ্বাসে ইন্ধন যোগায় মায়মুন। রোজ ভোরে সে পথের দিকে চেয়ে থাকে। করিম বক্শকে দেখতে পেলেই সে হুশিয়ারী সঙ্কেত দেয়। করিম বক্শ ব্যর্থ হয়ে শফির মা-র ঘরে গিয়ে কথাবার্তা বলে। তার ছেঁচা পানে ভাগ বসায়।
–কি করলা, ভাজ? পরস্তাবডা করছিলা? করিম বক্শ জিজ্ঞেস করে।
—করছিলাম। কিন্তুক রাজী অয় না। বহুত দিন ধইর্যা আমিও চেষ্টা করতে আছি। চক-চেহারায় তো কম না। মাইনষে দ্যাখলে এহনও এক নজর চাইয়া দ্যাহে। ষাইডের বান্দে ছান্দেও ঠিক আছে। এহনও নিকা দিলে গণ্ডায় গণ্ডায় বাচ্চা-কাচ্চা অয়। আমি এত কইর্যা বুঝাই, আমার কথা কানেই নেয় না। গদু পরধান কত ঘুরাঘুরি করে! দুই কানি জমিন আর একখান ঘর লেইখ্যা দিতে চাইছিল।
—আমি ভালার লেইগ্যা কইছিলাম। আমার সংসারও চলত, আর আমার পোলা মাইয়াও সুখে থাকত। আমার তিন কানি জমিন ওর নামে দলিল রেজেষ্টি কইর্যা লেইখ্যা দিতাম। তুমি আর একবার কইয়া দেইখ্য না। যদি সতীনের ঘর করতে রাজী না অয়, তয় আঞ্জুমনরেও তালাক দিয়া দিতে পারি। এর বেশী আর কি চায়?
—কিন্তুক ও যে কিছুই চায় না। আমার মোখের উপরে কইয়া দিছে,—’যেই থুক একবার মাডিতে ফ্যালাইছি, তা মোখ দিয়া চাটতে পারতাম না।’
করিম বক্শ এবার ফতুয়ার পকেট থেকে একটা পান বের করে শফির মা-র হাতে দিয়ে বলে-খবরদার কেও যেন না জানে। তোমার ঘরে ডাক দিয়া এই পানডা খাওয়াইয়া দিও। নাগর বাইদ্যার আতে পায়ে ধইর্যা এইডা যোগাড় করছি। বান্দরের নউখের কলম আর মানিকজোড়ের রক্ত দিয়া এই পানের উপরে লেইখ্যা দিছে আর কইয়া দিছে,—’সাত রোজের মইদ্যে যদি ও তোমার লেইগ্যা পাগল না অয় তো আমার নামে কুত্তারে ভাত দিও।’
১৮. টিয়া-ঠুঁইট্যা আমগাছ
–কারা ওইখানে? কেডা, কেডারে? শফির মা চেঁচিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।–খবরদার, ফলগাছে কোপ দিলে আজগাই ঠাডা পড়ব মাতায়, কইয়া রাখলাম।
কে একজন বলে—আমরা কিনছি এই গাছ। জিগাও গিয়া হাসুর মা-রে।
শফির মা রাগে গরগর করতে করতে আসে—অ্যাই হাসুর মা, টিয়া-ঠুঁইট্যা আমগাছটাও বেচ্ছস?
—হ, গফুর শেখ নিছে ওডা, দশ টাকায় লাকড়ির লেইগ্যা।
—ওহুঁ, যেই নেউক, ওই গাছ আমি কাটতে দিতাম না।
—ক্যাঁ? ওই গাছ তো আমার ভাগের।
—ওই গাছ তোর তা মুল্লুকের মাইনষে জানে। কী সোন্দর আম অইছে গাছটায়। জষ্টি মাসে পাকব। তুই এই গাছ বেচ্লি কোন আক্কেলে? বাচ্চা-কাচ্চারা কি মোখে দিব?
এক সঙ্গে অনেকগুলো কথা চেঁচিয়ে বলে শফির মা হাঁপিয়ে ওঠে।
–-কি মোখে দিব আবার? আগে ভাত খাইয়া বাঁচলে তারপর তো আম-জাম।
শফির মা ভেঙচিয়ে ওঠে—তারপর ও আম-জাম! আমের দিনে বেবাকে আম খাইব, আর ওরা মাইনষের মোখের দিক চাইয়া থাকব। কর যা তোর মনে লয়। তুই গলায় দড়ি দিলেও আর আমি না করতাম না।
দুইদিন বাদে গলায় দড়িই দিতে অইব। কি করতাম আর! তোমরাই হে-সুম ধইরা-বাইন্দা তোবা করাইলা। ঠ্যাং ভাইগা কতদিন ধইরা বইস্যা আছি। একটা না, দুইডা না, চাইরখান প্যাডের ভাত আহে কই তন?
শফির মা ক্ষুব্ধ হয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। বাড়ীর দক্ষিণ পাশ থেকে গাছ কাটার শব্দ আসে। জয়গুনের বুকের ভেতরেও যেন কুঠারের আঘাত পড়ছে বারবার।
টিয়াঠুঁটে আম গাছটায় আম ধরেছিল এবার খুব। আমও জাতের আম। দুধে মেশালে দুধ নষ্ট হয় না, এত মিষ্টি আমের তলার দিকটা টিয়ার ঠোঁটের মত বাকা। আর পাকলে ঐ ঠোঁটটাই শুধু লাল হয়।
হাসু ও মায়মুন গাছে বোল দেখে কত খুশী হয়েছিল! আর একটা মাস রয়ে সয়ে বেচলে ওরা খেতে পারত। কিন্তু এদিকে পেট তো আর ক্ষুধার জ্বালায় ‘র’ মানবে না।