করিম বক্শ আস্তে আস্তে বারান্দায় নেমে আসে। আওয়াজ পেয়ে জয়গুন গা ঝাড়া দিয়ে বসে। তাড়াতাড়ি মাথার কাপড় লম্বা করে টেনে দেয়।
করিম বক্শ এসে কাসুর মাথায় হাত দিয়ে শরীরের তাপ দেখে। জয়গুন বুঝতে পারে, কথা বলার ভূমিকা ছাড়া এ আর কিছু নয়। সে একটু দূরে সরে বসে হাসু ও মায়মুন যেখানে শুয়ে আছে।
করিম বক্শ বলে—আমারে দেইখ্যা তুমি ঘুমডা দ্যাও ক্যাঁ?
বার তিনেক হল এই একই অভিযোগ।
জয়গুন উত্তর দেয় না।
—আমারে আবার শরম কিয়ের? এত বচ্ছর আমার ঘর করলা, আর এহন আমারেই শরম! মাথার কাপড় উডাও, লক্ষ্মী। হোন আমার কথা।
জয়গুনের বুকের ভেতর টিপটিপ করতে শুরু করে।
করিম বক্শ বলে—আমার কথা যদি রাখ, তয় একটা প্রস্তাব করতে চাই।
জয়গুন নিরুত্তর।
-আইচ্ছা, আমি যদি আবার—
জয়গুন শক্ত একটা কিছু বলার জন্যে মনে মনে মুসাবিদা করে কিন্তু মুখ দিয়ে কিছু বের হয় না।
—তোমারে আবার আমি ঘরে আনতে চাই।
কম্পিত কণ্ঠে জয়গুন বলে–না।
-ক্যাঁ? আমি শরা-শরিয়ত মতই করতাম।
শরিয়ত মত আগে একজনের লগে সাঙ্গা বইয়া হেইখান তন তালাক লইয়া তারপর? ওহোঁ।
—ওয়াতে দোষ কি? লক্ষ্মী, তুমি রাজী অও। তহন কি আম্মুকি করছি ঘরের লক্ষ্মী ছাইড়্যা দিয়া। শরিয়তে আইন আছে এই রহম নিকার।
—শরিয়তে থাকলেও আমি পারতাম না।
—ক্যাঁ? সতীনের ঘর বুইল্যা? যদি একবার মোখ ফুইট্যা কও ‘সতীনের ঘর করতাম না’ তয় ফুলির মা-রে রাইত পোয়াইলেই খেদাইয়া দিতে পারি। তুমি একবার একটু–
—ওহোঁ।
—ক্যাঁ? ঘরের লক্ষী তুমি। করিম বক্শ জয়গুনের একটা হাত ধরে আকর্ষণ করার চেষ্টা করে। জয়গুন ঝাড়া দিয়ে সে হাত ছাড়িয়ে নেয়। পাশে হাসুকে হাত দিয়ে ধাক্কা দেয়—হাসু হাসু ওঠ।
করিম বক্শ চোরের মতো সরে যায়।
বাকী রাতটা জয়গুন বসে কাটিয়ে দেয়। প্রথম মোরগের বাকের সময়, সে হাসু ও মায়মুনকে ডেকে তোলে। কাসু ঘুমিয়ে আছে। তার রোগ-শীর্ণ পাণ্ডুর মুখের দিকে চেয়ে জয়গুন চোখের পানি রাখতে পারে না। কাসুর গালে একটা চুমো দিয়ে তার গালের সাথে নিজের গাল ঠেকিয়ে রাখে কিছুক্ষণ।
সে আঞ্জুমনকে ডেকে কাসুর কাছে রেখে যায়। আঞ্জুমন কিছু বুঝতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করে—আইজ যাইবা ক্যাঁ?
—যাইমু না কি করমু আর? এহন ও ভাল অইয়া উডব। তুমি এটু নজর রাইখ্য বইন। তোমার ত পোলা নাই। মনে কইর্য এইড়া তোমার প্যাডের।
জয়গুন বাড়ী এসে প্রথমেই শফির মার বিছানার পাশে গিয়ে বসে।
শফির মা বলে—চইল্যা আলি ক্যাঁ? তোরে দ্যাখতে না পাইলে যদি ও চিল্লায়?
—চিল্লাইলে কি করতাম, বইন? যার পোলা হে-ই রাখব। আমার কি! সখেদে বলে জয়গুন।
—আমার ত মনে অয় না করিম বক্শ ওরে রাখতে পারব। ঘুমের তন উইঠ্যাই যখন তোরে দ্যাখব না, তহন করিম বকশের দিল-কইলজাডা খুইল্যা খাইয়া ফ্যালাইব না!
—তার আমি কি করতাম! হেদিন কইছিলাম—ওরে আমার কাছে আইন্যা কিছু দিন রাহি। তারপর ভালা অইয়া গেলে যার পোলা হে-ই লইয়া যাইত। ব্যারাম তন ওঠলে এট্টু আবদার করব। হেইয়া সইজ্য আইলে তয় ত! কিন্তু তুমি মত করলা না।
–কেমন কইর্যা করি? আমাগ সূর্য-দীগল বাড়ী। এই বাড়ীতে মানুষ উজাইতে পারে না। আবার এক বছর ধইর্যা পাহারা নাই। এমন সোনার চান মানিকরে এইখানে আনলে যদি এটটু উনিশ-বিশ অয়, তয় বদনাম অইব তোর।
—ক্যাঁ। আমরা তো কতদিন ধইরা আছি। আমাগ কি অইছে?
আমাগ কতা আলাদা। আমাগ সইয়া আইছে। আর এতদিন বাড়ীর পাহারা আছিল। পাহারা যেই দিন তন নাই, হেই দিন তন আমার জ্বর যেন ঘন ঘন ওঠতে আছে! আবার মায়মুনেরও পরের বাড়ীর ভাত ওঠল। এইগুলা কি কম চোট?
সূর্য-দীঘল বাড়ীর অমঙ্গল আশঙ্কা করে জয়নুন সান্ত্বনা পাওয়ার চেষ্টা করে। তবুও তার মন মানে না। তার অন্তর কেঁদে ওঠে। রোগশীর্ণ কাসুর কান্না শুনতে পায় সে তার অন্তরে। স্পষ্ট দেখতে পায়, ঘুম থেকে জেগে কাসু মা-মা বলে কাঁদছে।
অসুখ ভালো হয়ে আসার পর প্রথম চোখ মেলেই সে মা-কে চিনতে পেরেছিল। তারপর যতক্ষণ সে জেগে থাকত, কখনও জয়গুনের বুকে মাথা রেখে, কখনও হাত আকড়ে ধরে থাকত। তার বিছানা ছেড়ে জয়গুনের কোথাও যাওয়ার উপায় ছিল না। সে কোথাও গেলে কাসু কান্না জুড়ে দিত। দুর্বল হাত-পা দিয়ে কাঁথা বালিশ ছুঁড়তে আরম্ভ করত। আজও জয়গুন তার মনের চোখে দেখতে পায়—কাসু পায়ের লাথি মেরে গায়ের কাঁথা ফেলে দিচ্ছে। করিম বক্শ বা আমন কেউ তাকে শান্ত করতে পারছে না।
আসলেও তাই ঘটেছিল। করিম বক্শ নানা রকম লোভ দেখিয়েও কাসুর কান্না থামাতে পারে নি।
রমেশ ডাক্তার জয়গুনকে আনবার জন্যে লোক পাঠাতে বলেছিলেন। কিন্তু তিনি করিম বক্শের কাছে জানতে পারেন, জয়গুন আর আসবে না।
ডাক্তার তার সুন্দর থার্মোমিটারটা কাসুর হাতে দিয়ে তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু সেটা সে মাটির ওপর ছুঁড়ে ভেঙে দেয়।
ডাক্তার করিম বক্শকে ভৎর্সনা করেন—শিগগির ওকে ওর মা-র কাছে পাঠিয়ে দাও। এভাবে একে রাখতে পারবে না। এখনও শরীর দুর্বল। এক্ষুণি নিয়ে যাও। দেরী করো না। আমি ওখানে গিয়ে দেখে আসব। ঐ তালগেছো বাড়াটা তো? হ্যাঁ, চিনেছি। ওর মা-র কাছে ভালো থাকবে।
করিম বক্শ কাচুমাচু করে। ডাক্তারের আদেশ লঙ্ঘন করার সাহস তার হয় না। সে যখন কাসুকে কোলে করে নিয়ে যায়, তখন রোদের তেজ বেড়েছে। মাঠের আধা-পাকা মশুর, কলাই ও সর্ষের গাছে শিশির তখনও ঝলমল করছে।