রাত্রে জয়গুনের কাছে থাকার জন্যে শফির মা আসে। সে ‘বুড়া মানু’ তাই তার ঘুম কম। রাত্রের যে কোন সময়ে ডাক দিলে তার সাড়া পাওয়া যায়। সে কাছে থাকলে মনে বল পাওয়া যায়। হাসুও দুই রাত্রি ছিল। কিন্তু ও ছেলে মানুষ। সন্ধ্যার পরেই ঘুমিয়ে পড়ে। সারা রাত্রির জন্যে আর তাকে সজাগ পাওয়া যায় না। শফির মা-র জন্যে জয়গুন। সন্ধ্যার আগেই বেশী করে পান ঘেঁচে রাখে, যাতে কাসুর কানের কাছে ঠনর ঠনর করতে না হয়।
শফির মা অনেকক্ষণ বসে থাকে জয়গুনের পাশে। তারা মুখোমুখি বসে। আগুনের মালসার ওপর হাতগুলোকে গরম করে। মাঝে মাঝে কান মুখ ও অন্যান্য অঙ্গে গরম হাত বুলিয়ে শীত তাড়াবার চেষ্টা করে। শফির মা কখনও পান চিবোতে চিবোতে পিচ ফেলে মালসার মধ্যে। তুষের আগুন থেকে ধোঁয়া বের হয়। নানা কথায় সে জয়গুনকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করে। তার নিরাশ মনে আশা জাগিয়ে তোলে। থানার ঘন্টা যখন জোড়ায় জোড়ায় বাজে, তখন সে গুণতে আরম্ভ করে সাথে সাথে। বলে—বারোখান বাজল। এইবার এট্ট কাইত অই। আত দিয়া দ্যাখ, কাপড় ভিজা প্যাচপেইচ্যা অইয়া গেছে।
শফির মা কাঁথা উঠিয়ে মায়মুনের পাশ দিয়ে শুয়ে পড়ে। তার শীতল শরীরের ছোয়া লেগে মায়মুন একবার নড়াচড়া করে ওঠে। শফির মা বলে—চুপ কইর্যা থাক বেডি, অহনি উম অইয়া যাইব।
শফির মা গরম হাত দুটো মায়মুনের গায়ে বুলিয়ে এবার ক্ষতি পূরণের চেষ্টা করে। জয়গুনকে বলে—আমারিক্ত ঠাণ্ডা অইয়া গেছে। খাড়াকাড়ি গরম অয় না। ওগ রক্ত গরম। আমার শফিরে বুকে লইয়া হইলে মুহতুকের মইদ্যে উম অয়। তা না অইলে পৌষ মাইস্যা শীতে ঠকঠক করতে করতে জান কবচ অওনের জোগাড়। মাইনষে কইতেই কয়—
পৌষের হিমে ভীম দমন,
মাঘের শীতে বাঘের মরণ।
শফির মা শুয়ে শুয়ে গল্প আরম্ভ করে—ভীম একদিন তার মা-রে জিগায় ‘মা, আমার তন বড় জোয়ান কে? তার মা কয়—‘আছে একজন। গাঙ্গের পাড় দিয়া আঁটলেই তার দ্যাহা পাইবা। তহন পৌষ-মাইস্যা রাইত। ভীম কতক্ষুণ পর শীতে ঠকঠক করতে করতে বাড়ীতে আহে। মায় জিগায়—দ্যাহা পালি বাজান? ভীম কয় ‘হ গো মা।’
জয়গুন কাঠি দিয়ে তুষের আগুন ঘেঁটে তাতিয়ে নেয়। আগুনে হাত-পাগুলোকে গরম করে।
ঘরের বেড়ার ফাঁক দিয়ে উত্তুরে হিমশীতল বাতাস ঢোকে। জয়গুনের শরীরের রক্ত জমে ওঠে যেন!
বাতাসে নিবুনিবু করে কুপিটা। জয়গুন উঠে সলতে উস্কিয়ে দেয়। এক প্রস্ত কাঁথা এনে আগুনে গরম করে গায়ের ঠাণ্ডা স্যাঁতসেঁতে কাঁথাগুলো পালটিয়ে দেয়।
করিম বক্শ এক সময়ে ডাকে—কাসু কি ঘুমাইছে?
বার দুই ডেকে করিম বক্শ ক্ষান্ত হয়। শফির মা ঘুমিয়ে পড়েছে। জয়গুন ডান হাত বাড়িয়ে তাকে ধাক্কা দেয়। শফির মা ধড়ফড় করে ওঠে। দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলে—আল্লা-রছুল! কি কাসুর মা? সারা রাইত এম্বায় বইস্যা থাকবি? তুই আয়, আমার বালিশে মাথা রাইখ্যা এটু ক্যাইত অইয়া থাক। ও এহন চুপ মাইর্যা আছে।
করিম বক্শ আবার ডাকে—ও কি ঘুমাইছে?
—হ ভাই, এহন ঘুমেই আছে।
নিঝুম রাত। কোন দিকে সাড়া-শব্দ নেই। অনেকক্ষণ পরে পরে পাখীর কলবল এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। তারপর আবার নিস্তব্ধ। এমন নিস্তব্ধতার মধ্যে ঘরে শোয়া করিম বক্শের নিশ্বাস পতন পর্যন্ত গণনা করা যায়। কানের কাছে কাসুর বুকে কফের ঘ্যাড়-ঘ্যাড় শব্দ এবং তার অনিয়মিত হ্রস্ব দীর্ঘ শ্বাস-প্রশ্বাস জয়গুনের আশঙ্কাঘন মনে উদ্বেগ বাড়িয়ে দেয়। ঘন কালো অন্ধকার যেন চারদিক থেকে গিলে ধরবার জন্যে হা করে আছে।
শেষ রাতে ভয়ঙ্কর শীত নেমে আসে। জয়গুন আর একবার কাঁথা বালিশ গরম করে কাসুর বিছানা বদলে দেয়। নিজের হাত-পা শরীর তুষের আগুনের তাপে গরম করে। তারপর কাসুর কাঁথার নিচে শুয়ে তাকে নিজের বুকের তাপ দিয়ে গরম করবার চেষ্টা
সপ্তাহ খানেক পরে একদিন ডাক্তার বলেন—আর চিন্তা করো না, মা। ভয় কেটে গেছে। তোমার ছেলে এবার ভালো হয়ে উঠবে!
জয়গুনের মুখের ওপর থেকে নৈরাশ্যের মেঘ কেটে যায়। আশার আলোয় মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তার। ডাক্তারের ওপর কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে বুক। কিন্তু তাকে কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা তার জানা নেই। সে বলে–বাবা—তুমিই আমার কাসুরে বাঁচাইল। মরণঘর তন তুমিই ওরে ফিরাইয়া আনছ।
ডাক্তার আশ্চর্য হন। তার সমস্ত জীবনে এমন সহজ সোজা কথা কোন নিরক্ষরের মুখে তিনি কখনও শোনেন নি। ডাক্তার মানুষ বাঁচাতে পারে, এ-কথা বিশ্বাস করে না কেউ।
ডাক্তার বলেন—আমার চিকিৎসা ছাড়াও তোমার শুশ্রূষা অনেক সাহায্য করেছে। তুমি কাছে না থাকলে, সময় মত ওষুধ-পথ্য না দিলে এ রোগী বাঁচান এত সহজ ছিল না।
কাসু ভালো হয়ে ওঠার সাথে সাথে জয়গুনের কর্তব্যও যেন ফুরিয়ে যায়। একদিন ভোর রাত্রে কাসুকে ঘুমে রেখে সে মায়মুনকে নিয়ে হাসর সাথে বাড়ী চলে আসে।
জয়গুনের এমনি করে চলে আসার কারণও ‘ঘটেছিল।
শফির মা সেদিন আসে নি। জ্বর হয়েছিল তার। রাত্রে মা-র কাছে থাকবার জন্যে হাসু এসেছিল।
গভীর রাত্রি। হাসু ও মায়মুন ঘুমে অচেতন। কাসুও কতক্ষণ ছুটফট করে কিছু আগে। মুমিয়ে পড়েছে। তার শিয়রে আগুনের মালসার ওপর হাত রেখে জয়গুন ঝিমোচ্ছে।
করিম বক্শ অন্ধকারে বালিশ থেকে মাথা উঁচিয়ে ঘর ও বারান্দার মাঝের বেড়ার ফাঁক দিয়ে তাকায়। কয়েকদিন ধরে তাকিয়ে তাকিয়ে তার কেমন নেশা ধরে গেছে। কুপির অস্পষ্ট আলোকে জয়গুনের মুখখানা বড়ই সুন্দর লাগে তার চোখে। চোখ দুটো ঘুমে ঢুলুঢুলু, কখনও বুজে আসে। সারা মুখে বেদনার ছাপ যেন সুন্দরতর করেছে তার মুখখানা।