বিরক্তির মধ্যেও নিজের রসিকতায় হেসে ওঠেন ডাক্তার। তার হাসি গিন্নীর অন্তরে ঘা দেয়। তিনি বলেন—তা তুমি যেয়ে।
—আমি যাব! উহুঁ! এখান থেকে আমি একচুলও নড়ছিনে। এমন সাজানো বাগিচা ছেড়ে নরকে যেতে পারবো না।
কথায় সুবিধা করতে না পেরে গিন্নী বলেন—তা বেশ। এখানে থেকে মুসলমানের হাতে যদি কচুকাটা না হও তো কি বল্লাম।
—ওসব বাজে কথা রাখ। এখানে কে তোমাকে মারছে শুনি? কতগুলো পশুর প্ররোচনায় যা হয়েছিল, তা আর হবে না দেখে নিও। ভাইয়ের বুকে ছুরি বসিয়ে আনন্দ পাওয়া যায়
—সবাই বুঝতে পেরেছে। ভাইয়ের বুকের রক্তে যে করুণ অভিজ্ঞতা হল, হিন্দুমুসলমানের মন থেকে তা সহজে মুছে যাবে না। আর যদি একান্ত মুছেই যায়, তবে বুঝব তার পেছনে কাজ করেছে স্বাথান্ধ হিংস্রতা। শুধু এখানেই নয়। সব জায়গায় এ হিংসতা দেখা দিতে পারে। যেমন আসামে ‘বঙ্গাল খেদা’ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। ধুতিবালাদের বিরুদ্ধে মুখারা কুকরি শান দিচ্ছে। বিহারে কোণঠাসা করে রাখা হচ্ছে বাঙালীকে। এখন এক গণ্ডগোলের ভয়ে পালিয়ে আর এক গণ্ডগোলের মুখে গিয়ে পড়তে হবে। এখানে আমাদের কিসের অভাব? কোন দুঃখে যাব আমরা ঘর-বাড়ী ছেড়ে? জানো না, এখানে আমরা মার কোলে আছি।
হাসু এসে ডাক্তারের উঠানে দাঁড়ায়।
ডাক্তারের খোঁজে সে এ-গাও ও-গাও ঘুরেছে। জগদীশ ডাক্তারকে পাওয়া গেল না। তিনি পাততাড়ি গুটিয়েছেন। আজই চলে যাচ্ছেন দেশ ছেড়ে। হরেন ডাক্তারও নেই। তিনি অনেক দিন আগেই চলে গেছেন। তার শূন্য ভিটা তচনচ হয়ে আছে ঘাস-লতা-পাতায়।
রমেশ ডাক্তার তখনও বকে চলেছেন—এখন হুজুগে মেতে অনেকেই বাড়ী-দরি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। যাদের টাকা নেই তারাও যাচ্ছে। অনেকে বাড়ী-ঘর বিক্রি করে যাচ্ছে। আমি বুঝতে পারি না কিসের নেশায় যাচ্ছে এরা। কিন্তু দেখবে, আবার এরা ফিরে আসবে। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, ক্ষুধা ও রোগে আধমরা হয়ে আবার এরা ফিরবে। কিন্তু তখন আর মাথা খুঁজবার ঠাঁই মিলবে না। আমাদের পূর্বপুরুষ হিন্দু-মুসলমান আপনজনের মত কত যুগ ধরে কাটিয়েছে এ মাটিতে। একের ওপর নির্ভর করে বেঁচে উঠেছে আর একজন। একজন যুগিয়েছে ক্ষুধার অন্ন, আর একজন দেখিয়েছে আলো।
ডাক্তার পাশের দিকে দেখেন–গিন্নী নেই। কখন তিনি বেরিয়ে গেছেন। উঠানে হাসু দাঁড়িয়ে। দেখতে পেয়ে ডাক্তার বলেন—কিরে বাপু, কি চাই।
—আমার ভাইয়ের খুব অসুখ।
স্ত্রীর ওপর এতক্ষণ বক্তৃতা ঝেড়ে রমেশ ডাক্তারের মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে আছে। তিনি বলেন—আমি যেতে পারব না।
কথাটা বলে তখনি ভাবেন—আর তো কেউ নেই। হরেন অনেক দিন আগেই চলে গেছে। জগদীশও আজ যাচ্ছে। এ তল্লাটে এ তিন হন ছাড়া আর কে আছে? ডাক্তার যাবার মনস্থ করেন। বাড়ীতে থাকলে আবার স্ত্রীর কথায় কান ঝালাপালা হয়ে যাবে। তার চেয়ে বরং রোগী দেখতে যাওয়া ভালো।
জামা গায়ে চড়িয়ে স্টেথসকোপ ও ‘এমারজেন্সী ব্যাগ’ নিয়ে ডাক্তার বের হন। পেছন থেকে স্ত্রী বাধা দেন—এই দুপুরে রোদ মাথায় করে কোথায় চল্লে আবার?
উত্তর না দিয়ে ডাক্তার এগিয়ে যান।
—চান করে খাও-দাও। বিকেলে যেও। স্ত্রী তাগাদা দেন।
স্ত্রীর কথাগুলোকে শ্লেষের আঘাত করে ডাক্তার বলেন—চান করব আবার খাব। এদিকে মানুষ মরে যাচ্ছে।
পেছন ফিরে ডাক্তার আবার বলেন—এখন দেখো, আমরা চলে গেলে এদের কি উপায় হবে। এতগুলো গ্রামের মধ্যে আমরা তিনটে ডাক্তার ছিলাম। দু’জন তো চলেই গেল।
আমিও যদি চলে যাই, তবে এরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
ডাক্তারের ব্যাগটা হাসু হাতে করে নেয়।
ডাক্তার রোগী দেখে চিন্তিত মুখে বলেন—ডবল নিমোনিয়া। এত দিন ছিলে কোথায়?
করিম বক্শ বলে—ফকির দেখছিল এতদিন।
—নাকের ওর ঘা হয়েছে কেমন করে?
–দড়ি-পড়া দিছিল ফকির।
ডাক্তার দাতে দাঁত চেপে বলেন—ফকির! দড়ি পড়া! দেশের শাসন ক্ষমতা আমার হাতে থাকলে ব্যাটাদের কুরবাজি দেখিয়ে ছাড়তাম। ফাঁসি দিতাম ব্যাটাদের। এ নরহত্যা ছাড়া কিছু নয়।
ডাক্তার আসায় জয়গুন বড় করে মাথায় কাপড় টেনে পেছন ফিরে বসেছিল। তার বুকের ভেতর কে যেন হাতুড়ি পিটছে অবিশ্রান্ত। সে এবার ঘুরে ডাক্তারের পা ধরে করুণ মিনতি জানায়—ডাক্তার বাবু, আমার কাসুকে বাঁচাইয়া দ্যান। আপনে আমার ধর্মের ব্যাপ।
১৭. জয়গুন আহার-নিদ্রা ভুলে
জয়গুন আহার-নিদ্রা ভুলে দিনের পর দিন ছেলের শয্যা-পার্শ্বে কাটিয়ে দেয়। মায়মুনও থাকে মা-র কাছে। প্রত্যেক দিন খাবার সময়ে করিম বক্শের ইঙ্গিতে আঞ্জুমন জয়গুনের হাত ধরে টানাটানি করে খাওয়ার জন্যে। বলে—এই রহম পেডে পাথর বাইন্দা থাইক্য না। দুইডা দানাপানি মোখে দ্যাও বুজান, নালে শরীল তোমার ভাইঙ্গা যাইব।
জয়গুন খেতে যায় না। সে ভাবে, এ বাড়ীর ভাত তার কপাল থেকে অনেক আগেই উঠে গেছে।
হাসু রোজ খাবার নিয়ে আসে। রেখে যাওয়া সে খাবার সে মায়মুনকে দেয়। নিজেও খাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তার খাওয়া আসে না। দু’এক মুঠো জোর করে গিলে এক মগ পানি খেয়ে একদিন কাটিয়ে দেয়।
দিনের বেলা যেমন তেমন কেটে যায়। কিন্তু রাত্রি বেলা জয়গুনের আর দুশ্চিন্তার অন্ত থাকে না। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই সে রাত্রির জন্যে প্রস্তুত হয়। বাতির তেল না থাকলে মায়মুনকে পাঠিয়ে পাশের বাড়ী থেকে কুপি মেপে তেল ধার আনে। একটা মালসাতে তুষ সাজিয়ে আগুন দিয়ে রাখে।