একটু দম নিয়ে আবার তিনি আরম্ভ করেন—আমাদের হাতে সব লোকই যে বাঁচবে তা তো বলছি না। এর কারণ অনেক। একটা কারণ হচ্ছে–চিকিৎসাবিজ্ঞানে আমাদের অজ্ঞতা। আমার হাতে যে রোগী মারা গেল, আর একজন ভালো ডাক্তারের কাছে সে হয়তো মরত না। তা ছাড়া রোগ নির্ণয়ে, ওষুধ-নির্বাচনে ভুল-ভ্রান্তি, ওষুধের অভাব, যন্ত্রপাতির অভাব—নানা কারণ আছে। এ ছাড়াও আছে রোগীর গাফিলতি। সময় থাকতে আসবে না। আসবে তখন যখন টলমল অবস্থা। ঐ অবস্থায় ডাক্তার ডেকে কোন কাজ হয় না। ডুবন্ত নৌকা উদ্ধার করা সোজা ব্যাপার নয়। কথায় বলে—মরণকালে লক্ষ্মীবিলাসের বড়ি কোন কাজ দেয় না। মানুষ মরবে, এতে সত্য কথা। তবে অকালমৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাবার চেষ্টা করতে হবে তো। বাতির তেল ফুরালে তেল দিতে হবে। ঝড়ে নিবে না যায়। তার জন্য ঢাকনা লাগাতে হবে। বাতিটা যে-দিন ফুটো ঝাঁজরা হয়ে ভেঙে যাবে, সে দিনের কথা আলাদা। অবশ্য সমস্ত লোককে অকাল মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাবার মত চিকিৎসা এখনও আবিষ্কার হয়নি। তবে চিকিৎসাশাস্ত্রের উন্নতি হচ্ছে দিন দিন।
সবাই বিরক্ত হয় ডাক্তারের ওপর। তারা মনে করে—আজ মাথাটা একটু বেশীই খারাপ হয়েছে ডাক্তারের।
কালীপদ বলে রাখ তোমার বক্তিমা। এইবারে বিদায় কর। ডাক্তার বলেন—একটু সবুর কর। ওদের আগে বিদায় করি। ওরা দূরের লোক। এসো দেখি দিল মহম্মদ। ক’দিন থেকে জ্বর?
—আইজ চাইর দিন।
ডাক্তার নাড়ী দেখেন। বুক পরীক্ষা করেন। তারপর বলেন—দেখি জিভ। হা করো, আ—এমন করে।
দিল মহম্মদ হা করে। তার নিশ্বাসের সাথে এক ঝলক দুর্গন্ধ এসে ধাক্কা মারে ডাক্তারের নাকে। তিনি মুখটা একপাশে সরিয়ে বলেন—কোষ্ঠ পরিষ্কার হয়নি।
একটা কাগজে ‘ব্যবস্থা’ লিখে ডাক্তার বলেন—কোন ভয় নাই। এ কাগজটা কম্পাউডারকে দাও। ওষুধটা দিনে তিনবার খাবে। ঠাণ্ডা লাগিও না। শিশি এনেছো?
–হ্যাঁ।
–আচ্ছা যাও। পরশু এসো আবার। আলাউদ্দিন, তুমি এসো। কি তোমার?
—প্যাটটা ফুইল্যা রইছে দুই দিন ধইর্যা। একবার খাইলে আর খাইতে ইচ্ছা করে না।
ভাত দেখলে বমি আহে। খোয়াবে খাইলে হুনছি এই রহম অয়।
—অ্যাঁ, কি বল্লি?
–মা কইছে, খোয়াবে যারা খায়, তাগ প্যাট ভার অইয়া থাকে এই রহম। অজম অয় না।
বুড়ো ন’কড়ি বলে—ডাক্তারের কাছে এগুলা কইস না। এই সব ভূতের ব্যামোর কিছু ডাক্তার বুঝবও না, বিশ্বাসও করব না। আমিও কত দিন স্বপ্নে খাইছি—রসগোল্লা, সন্দেশ, জিলাফি, কচুরী, পানতুয়া—ন’কড়ি মিষ্টির নামের শিকলি ছাড়তে শুরু করে।
মুচকি হেসে ডাক্তার বলেন—খেতে কেমন লাগে?
—কেমন লাগবে আবার! ভালা। ঠিক হালুইকরের মিষ্টির মতন। কিন্তুক অজম অইতে চায় না। অজম অইলে কি আর কথা আছিল?
ডাক্তার রহস্য করে বলেন—সত্যি, হজম হলে আর কোন কথা ছিল না। বাজারে যখন রসগোল্লা সন্দেশ পাওয়া যায় না আজকাল, তখন স্বপ্নে বিনে পয়সায়—
—বেশ মজা কাইরা খাওয়ন যাইত। ডাক্তারের মুখের কথা লুফে নিয়ে ন’কড়ি বলে।
ডাক্তার এবার গর্জন করে ওঠেন—হুঁহ্, যত সব আহম্মক নিয়ে কারবার। যা এখন থেকে। স্বপ্নে রসগোল্লা খা গে। ওষুধ খেতে হবে না।
আলাউদ্দিন দাঁড়িয়ে থাকে। ডাক্তার হাত বাড়িয়ে তাকে একটু কাছে টেনে নেন। জামাটা তুলে রাগের সাথে জোরে জোরে তার পেট টিপতে শুরু করেন।
বাধা-ধরা একঘেয়ে জীবন ডাক্তারের এমনি করেই চলে। চলে ঘড়ির কাঁটার মত একই পথে। কিন্তু তার কাছে বৈচিত্র্যহীন একঘেয়ে বলে মনে হয়নি কোনদিন। মুর্খ লোকের কার্য-কারণহীন আজগুবি কথাবার্তা শুনে তিনি যত বিরক্ত হন, তাদের অজ্ঞতার জন্যে তার চেয়েও বেশী সহানুভূতি জাগে তার মনে। এ সমস্ত লোকের নাড়ী দেখে দেখে তাদের ওপর কেমন একটা নাড়ীর টান জন্মে গেছে ডাক্তারের। ভোর বেলা এদের মুখ দেখলে তবেই তার ভালো লাগে। তাজা হয়ে ওঠে দেহ-মন।
কিন্তু কিছুদিন ধরে ডাক্তারের দিনগুলো আর চলতে চায় না। যেন হুঁচোট খেয়ে চলছে দিনগুলো। স্বাধীনতা অর্জনের পরে বাস্তুত্যাগের হিড়িক পড়েছে দেশে। ভারত ও পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের চোখে লেগেছে আলোর ধাঁধা। ডাক্তারের স্ত্রীর চোখেও তাই লেগেছে। পাকিস্তান ছেড়ে যাওয়ার জন্যে তিনি অধীর হয়ে উঠেছেন। কিন্তু ডাক্তারের পাকা চোখে দূরের সে আলো নেশা জাগাতে পারে না। পারে না মায়ার সৃষ্টি করতে। স্বামী-স্ত্রীর এই বিরুদ্ধ মনোভাব সংসারের সমস্ত শান্তি নষ্ট করেছে। এই একই প্রসঙ্গ নিয়ে কথার প্যাচাল শুরু হয় দু’জনের মধ্যে। সহজে তা থামতে চায় না। স্ত্রী নানারকম যুক্তিতর্কের অবতারণা করেন, বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দৃষ্টান্ত দেখিয়ে স্বামীকে প্ররোচিত করেন। কিন্তু আদম তার সংকল্পে হল। সে জানে, নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার অর্থ স্ব-ভ্রষ্ট হওয়া। ঈভ তাই নিষিদ্ধ ফলের সাজি নিয়ে ব্যর্থ হয় বারবার।
আজও ডাক্তার রোগী দেখা শেষ করে সবে আঙিনায় উঠেছেন অমনি গিন্নী আরম্ভ করেন—ওগো শুনছো? আর তোমাকে বলেই বা কি হবে?
অন্যমনস্কভাবে ডাক্তার এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু গলা চড়িয়ে গিন্নি বলেন—জগদীশ ডাক্তার আজ যাচ্ছে, শুনেছো?
—তাতে হয়েছে কি?
—হবে আবার কি? সবাই একে একে চলে যাচ্ছে। আর আমরা এখানে জপমালা নিয়ে বসে থাকি আর কি!
–হ্যাঁ, মালা জপতেই শুরু কর। তাই ভালো। দেখো ঈশ্বর যদি কিছু ব্যবস্থা করেন। চাও তো পুষ্পক রথও পাঠিয়ে দিতে পারেন তোমার জন্যে।