বিকেলবেলা মায়মুন বড়শী নিয়ে তেঁতুলতলা গিয়ে বসে। যাবার আগে আণ্ডা দুটো আর একবার দেখে যায় দুই চোখে। সন্ধ্যা পর্যন্ত ও বসে থাকে বড়শী নিয়ে। পিঠালী সব শেষ। হয়ে যায়। কিন্তু মাছ ওঠে মাত্র একটা টেংরা, তিনটে পুঁটি আর কয়েকটা ডানকানা। মাছগুলো যেন ওর চেয়েও চালাক হয়ে গেছে।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ঘরে সঁঝবাতি দেখিয়ে আবার নিবিয়ে দেয় মায়মুন। আবছা অন্ধকারে বসে মাছ কয়টা কুটে লবণ দিয়ে রাখে।
রাত ন’টা দশটা পর্যন্ত অন্ধকারে ওকে একা বসে থাকতে হয় প্রায়ই। মায়মুনের বড় ভূতের ভয়। কোনো কোনো দিন সে শফির মার ঘরে গিয়ে কেচ্ছা শোনে। তার পান ছেঁচে দেয়। কিন্তু আজ সে দুপুর বেলা বেরিয়ে গেছে, এখনো ফেরেনি। ভিক্ষে করে খায় সে। মাঝে মাঝে বাড়ীও আসে না। মায়মুন দোরের ঝাপ বন্ধ করে দিয়ে চুপ-চাপ পড়ে থাকে।
রাত গোটা নয়ের সময় হাসু আর হাসুর মা আসে। শব্দ পেয়ে মায়মুন মাথার ওপর থেকে কাঁথা সরিয়ে ভয়ে ভয়ে চোখ মেলে।
মায়মুন এবার লাফ দিয়ে ওঠে। খুশীতে আটখান হয়ে সে বলে—মা, মা, আমাগ আঁসে আণ্ডা পাড়ছে। বলতে বলতে সে বের করে আনে ডিম দুটো। হাসু খুশী হয়ে ওঠে। হাতে নিয়ে দেখে, কী সুন্দর সাদা আর বড়।
হাসু বলে—কাইল অই আণ্ডা বিরান খাইম মা,পান্তা ভাত দিয়া।
—ই–স! বাচ্চা ফুডাইমু আমি। প্রতিবাদ করে বলে মামুন।
জয়গুন বলে—ওহোঁ। পয়লা দিনের আণ্ডা। আণ্ডা দুইডা জুম্মার ঘরে দিয়া আবি নামাজের দিন।
ভাই-বোন দুজনেরই মুখের হাসি মিলিয়ে যায়।
জয়গুন তাড়াতাড়ি চুলো ধরায়। রাতের জন্য মুঠ মেপে ছয়মুঠো ও ভোরের জন্য আরো ছয়মুঠো চাল নিয়ে সে হাঁড়ি বসায় চুলোর ওপর। ছেলেকে হুকুম দেয় কয়েকটা কুমড়ো পাতা তুলে আনতে। নিজে সে যায় না। বাচ্চা-কাচ্চার মা, রাত-বিরাতে গাছের ফল-পাতা ছিঁড়তে নেই।
ভাত ফুটিয়ে মায়মুনের ধরা মাছ কয়টা রাঁধতে দেরী হয় না।
তিনটি বাসনে ভাত বাড়ে জয়গুন, আর আন্দাজ করে—হাঁড়িতে কতটা আছে। ফেনটাও ভাগাভাগি করে নেয়। খেতে খেতে হাসু বলে—ফেনডাত খুব ঘন মা, মিডা মিডা লাগে।
—নয়া আউশ যে। এর লাইগ্যাইত আউশ চাউল আনলাম। দরেও হস্তা। ফেনডাও অয় ভালা। কিন্তু ভাতে বাড়ে না এক্কেরেই। অ্যাঁরে হাসু, নারাণগঞ্জে চাউল কি দর দেখলিরে আইজ?
—ট্যাহায় দেড় সের, মা।
—কি পোড়ার দ্যাশ দ্যাখ দেহি! উত্তুরে এডুক হস্তা না অইলে হুকাইয়া তেজপাতা অইয়া যাইতাম না? আইজ আড়াই সের ভাও আনলাম। আমন চাউল দুইসের কইরা।
–আমি একদিন তোমার লগে উত্তুরে যাইমু মা।
—ওহোঁ কাম কামাই দিয়া তোমার উত্তুরে যাওনের দরকার নাই বাজান।
খাওয়া শেষ হলে জয়গুন হাঁড়ির ভাতগুলোতে পানি ঢেলে রাখে। ছেলেমেয়ের জন্যে তেলচিটে একটা লম্বা বালিশ নামিয়ে দেয়। হাসু ও মায়মুন শুয়ে পড়ে। জয়গুন পানের ডিবাটা নিয়ে বসে এবার। আজ আর পানের ডিবা নেয়ার কথা মনে ছিল না তার। গাড়ীর মধ্যে ছমুর মা-র কাছ থেকে চেয়ে একবার মুখে দিয়েছে একটু। আর সারা দিনের মধ্যে সে পান খায়নি। তবু হাসু অনুযোগ দেয়—পান খাওয়া ছাইড়্যা দ্যাও, মা। পান আর আনতাম না আমি। চাইর পয়সা কি কম?
পান খাওয়া সে অনেক কমিয়েছে। চার পয়সার পানে দু’দিন যায় আজকাল। পান চিবোতে চিবোতে সে সারাদিনের দুঃখ-কষ্ট ভুলে যেতে চেষ্টা করে।
রাত অনেক হয়েছে। কুপিটা নিবিয়ে সে শুয়ে পড়ে।
০৩. আজকের ডিম দুটো মায়মুনের
আজকের ডিম দুটো মায়মুনের। সে বাচ্চা ফুটাবে। মা রাজী হয়েছে। সারা রাত তার ভাল ঘুম হয়নি। তার ছোট মনে কত কল্পনা জেগেছে। হাঁসের বাচ্চা হবে, সেগুলো বড় হবে, ডিম দেবে—ফকফকে সাদা ডিম। সেই ডিমের থেকে আবার বাচ্চা হবে। নানা রঙের হাসে তাদের খাঁচা ভরে যাবে। স্বপ্নেও সে দেখে রঙ-বেরঙুের হাসের সারি চলেছে ধানক্ষেতের মাঝ দিয়ে। ডিম কুড়িয়ে কুড়িয়ে সে একটা হাঁড়ি ভরে ফেলেছে।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই সে হাঁস দুটো ছাড়তে যায়। ঠিক ঠিক দুটো ডিমই পেড়েছে আজো। ডিম দুটো তুলে সে তুষের হাঁড়ির মাঝে রেখে দেয় আলাদা করে। সেখানে আগের দু’দিনের আরো চারটে রাখা হয়েছে। এক দুই করে গুণে দেখে মায়মুন একবার। তারপর হাঁস দুটো ছেড়ে দিয়ে সে চেয়ে থাকে। দু’তিনবার ডানা ঝাপটা মেরে হাঁস দুটো ভেসে যায় ধানক্ষেতের দিকে। মায়মুনের চোখ তৃপ্তিতে ভরে ওঠে। হাত-মুখ ধুয়ে মায়মুন ঘরে আসে। ডিম দুটো সে বুকের সাথে চেপে ধরে খুশীতে। জয়গুন বলে—অই রহম কইরা ধইরা রাখলে অই বাচ্চা অইব? বেবাকগুলা আণ্ডা লইয়া আয় আমার কাছে। বাছাই কইরা দেই। যেই আণ্ডাডা লম্ফা, হেইডায় অইব আঁসা, আর যেইডা গোল হেইডায় অইব অসী, গোল দেখে দুটো ডিম বেছে মায়মুনের হাতে দিয়ে সে আবার বলে—অই পাড়ায়। গিয়া দ্যাখ, কেউর মুরগীর উমে দিতে পারস যদি। হাসুও যা ওর লগে। তোর আর এই বেলা কামে যাওন লাগত না।
এ কথায় রীতিমত খুশী হয়ে ওঠে হাসু।
জয়গুন আরো বলে—দুফরে যাবি জুম্মার ঘরে। আণ্ডা চাইড্যা দিয়া আবি।
—চাইডা অই! হাসু আশ্চার্য হয়ে যায়—তুমি না হেদিন কইলা, পয়লা দিনের কেবল?
—দুইড্যা আণ্ডা জুম্মার ঘরে কেমন কইর্যা দেই, পাগল? এক আলির কমে—
–আমরা খাইমু না বুকিন একটাও?
—তুই আছস তোর প্যাট লইয়া।
খেয়ে দেয়ে সবাই বেরিয়ে পড়ে।
বর্ষার সময় বাড়ীর চারদিকে থাকে পানি। বিলের মাঝে একটা দ্বীপের মতো যেন। এ সময়ে নৌকা ছাড়া চলবার উপায় থাকে না। তারা সকলে তাদের কোষায় চড়ে ওপাড়ায় যায়। জয়গুন নামে মোড়ল বাড়ীর ঘাটে। সেখানে সে মাঝে মাঝে মোড়লদের ধান ভানে, চিড়া কোটে, ঘর লেপে দেয়।