শফির মা শফিকে সাবধান করে দেয়—জলদি কইর্যা যা। তোর কিন্তুক আবার শামুকের চলতি। দেরী করলে উফায় রাখতাম না।
নিয়মের দুনিয়ায় অনেক অনিয়ম আছে। ‘যেমন কর্ম তেমন ফল’ তাই সব সময়ে পাওয়া যায় না।
মাথার ঘাম পায়ে ফেলা সারাদিনের কর্মফল বড় সামান্য। পরোপকার প্রায়ই বিফলে যায়। সে কর্মে যদিও ফল ফলে, তা তিতো, বিষাক্ত।
এটা অনিয়ম বৈকি।
গ্রামের বুড়ো ডাক্তার রমেশ চক্রবর্তীর বেলায়ও এ অনিয়মটা নিয়মিত ভাবে বিদ্যমান। বিশ বছর রোগী দেখে, ওষুধ ঢেলে-গলে তিনি হাত পাকিয়েছেন। কিন্তু এই পর্যন্তই। চিকিৎসাবিজ্ঞানে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলেও অর্থ সঞ্চয় করেননি কিছুই। অসহায় রোগীর চিকিৎসার বোঝাই ঘাড়ে নিয়েছেন শুধু। টাকার সিন্দুক বোঝাই হল না কোনদিন।
সাধারণভাবে গ্রামের লোকের আস্থা নেই অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার ওপর। তাদের ধারণা—অ্যালোপ্যাথিকের তেজালো ওষুধ পেটে গেলে রোগী যা–ও দুঘণ্টা বাঁচত, তাও শেষ হয়ে যায় দুঘণ্টা আগেই। গ্রামে তাই ফকির-কবরেজদের পসার বেশী। ওষুধ মেশানো পানির চেয়ে বেশী কদর মন্ত্রপূত পানির। সোয়া সের চাল আর সোয়া পাঁচ আনা পয়সা দিয়ে যেখানে ফকির বিদায় করা যায়, সেখানে টাকা খরচ করে ডাক্তার বড় কেউ ডাকে না।
ধরাবাধা কয়েক ঘর লোক আছে রমেশ ডাক্তারের। ঘুরে ফিরে তারাই আসে। দু’টাকা দেয়, মাসখানেক ধরে চিকিৎসা করিয়ে নেয়। ওষুধ খেয়ে খেয়ে টাকার দাম তোলে। চিকিৎসায় টাকা খরচ করবার মত বড়লোক যারা, তারা এখানে আসে না। তারা যায় বড় ডাক্তার জগদীশবাবুর কাছে। দিনমজুরের কাছ থেকে দিন-মজুরী নিয়ে রমেশ ডাক্তারের দিন চলে টেনেটুনে।
রমেশ ডাক্তারের বাইরের ঘরটা একাধারে ডাক্তারখানা ও বৈঠকখানা দুই-ই। ঘরের এক পাশে দুটো আলমারী। তার মধ্যে নানা আকারের শিশি-বোতল সাজানো। ওগুলোর অধিকাংশই খালি। সুদিনে যখন ওষুধ পাওয়া যেত অপর্যাপ্ত, তখনও ওগুলো পুরোপুরি ভরা ছিল না।
আলমারীর একটা তাকে ভারী ভারী কয়েকখানা ডাক্তারী বই। ঘরের মাঝখানে একটা টেবিল। তার এক পাশে ডাক্তারের বসবার জন্যে একখানা কাঠের চেয়ার, অন্য তিন পাশে টিনের চেয়ার তিনখানা। এক পাশে একটা লম্বা টুল। দেয়ালে পিঠ ঠেস দিয়ে আরাম করে বসবার জন্যে টুলটাকে দেয়ালের কাছ ঘেঁষে রাখা হয়েছে। অপর পাশে দেয়ালের সাথে ঠেকানো একটা কাঠের চেয়ার। তার পেছনের একটা পায়া ভাঙা। আসন গ্রহণে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের হুশিয়ার করার জন্যে পায়া-ভাঙা চেয়ারটায় কে একজন একটা কাগজ এঁটে দিয়েছে। তাতে লেখা—খোঁড়া।
এত হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও নিরক্ষর গদু প্রধান একদিন চেয়ারটা নিয়ে পড়ে গিয়েছিল।
ডাক্তারের চোখের সামনে একটা দেয়াল ঘড়ি। বহু দিন ধরে অমেরামত পড়ে আছে। কোন রসিক লোক ডাক্তারের অনুপস্থিতিতে ঘড়িটার কাচের উপর একটা কাগজ এঁটে দিয়েছে। কাগজটিতে লেখা ‘কলেরা রোগী।‘
লেখাটা দেখে রমেশ ডাক্তার হেসে ফেলে বলেছিলেন-কলেরা নয়, কলেরা নয়। হৃদ-বন্ধ। কলেরা হলে এমন ওষুধ খাইয়ে দিতাম–
—কলেরার আবার চিকিৎসা আছে নি? ডাক্তারের কথা শেষ না হতেই জাফর মিয়া বলে।
—নেই কেন? নিশ্চয় আছে। জীবনে কত কলেরা রোগী ভাল করলাম এই হাতে।
—তয় হেইডা আসল কলেরা না। পেডের অসুখ। আসল কলেরা বসন্তু অইলে আবার মানুষ বাঁচে?
—বাঁচে না মানে? একশোবার বাচে। এবারও কত রোগী বেঁচে গেল আমার হাতে।
নিত্যানন্দ বলে—তুমি আবার মানুষ বাঁচাতে পার নাকি, ডাক্তার?
–নিশ্চয়ই পারি।
ডাক্তারের কথায় সবাই হেসে ওঠে। অনেকে মনে করে ডাক্তারের ক্ষ্যাপামিটা আজ আবার বেড়ে গেল।
—এ কি! তোরা হাসছিস? মানুষ যদি বাঁচাতে না পারি, তবে তোরা আসিস কেন? আমার ওষুধ খাস কেন? ডাক্তার টেবিলের ওপর চাপড় মারেন।
কালিপদ বলে তোমার কাছে আসি মনের শান্তির জন্যে, মনেরে বুঝ দিতে। তা ছাড়া কি! তুমি বাঁচাতেও পার না, মারতেও পার না। মরা-বাঁচা ঈশ্বরের হাত।
কালিপদ ওপর দিকে আঙুল দেখিয়ে ঈশ্বরের অবস্থান নির্দেশ করে।
মুখ বিকৃত করে রমেশ ডাক্তার বলেন—মরা বাঁচা ঈশ্বরের হাত! তবে দেব এক ফোটা পটাশিয়াম সায়নাইড? দেখি কে বাঁচায়?
নিত্যানন্দ বলে—তোমার ঐ বাজে কথা রাখ ডাক্তার। মাথাটা তোমার আজ আবার গরম হয়েছে, বুঝলাম। জগদীশ সেন এত বড় ডাক্তার, সেও এত বড় কথা বলতে সাহস করে না। ঈশ্বরের ওপর ভরসা করে সে। সেদিন অজিত চৌধুরীর ছেলে মারা গেল। জগদীশ ডাক্তার চৌধুরীকে বল—আমরা ওষুধ দিতে পারি, জীবন তো আর দিতে পারি না।
—ও সব ফাঁকা কথা বুঝলে? অজ্ঞতা ঢাকবার পথ ওটা। লোককে সান্ত্বনা দেওয়ার বুলি। আসলে ও কথার কোন অর্থ হয় না। এমন অনেক রোগী আছে, যার বাবার ভরসা ছিল না, আমাদের ওষুধ খেয়ে সে হয়তো বেঁচে যায়। যখন বেঁচে ওঠে তখন নাম হয় উপরওয়ালার। তার গুণকীর্তন হয়। মসজিদে শিরনি দেওয়া হয়। হরিলুট দেওয়া হয় মন্দিরে। আমাদের নামও নেয় না মুখে। জালাল শেখের টাইফয়েড হয়েছিল, জানো তোমরা। দুই মাইল পথ হেঁটে রোজ সকালে বিকালে হাজিরা দিয়েছি, ওষুধ দিয়েছি। আমার কাছে ক্লোরোমাইসিটিন ছিল না। জগদীশের কাছ থেকে নিজের টাকায় কিনে দিয়েছি। যখন বেঁচে গেল, তখন একদিন দেখাও করলে না এসে। আমাকে দিয়েছিল কত জানো? তিন টাকা। শুনেছি, আজমীরের দরগায় জালাল পাঁচ টাকা মানত পাঠিয়েছে।