কিন্তু বাড়ীতে পা দিয়ে মা-র কর্কশ জেরার মধ্যে পড়ে তার বুক দুরু দুরু করতে থাকে।
জয়গুন আবার জিজ্ঞেস করে–কি দোষ করছিলি?
—কিচ্ছু দোষ করি নাই মা।
—দোষ-ঘাইট না করলে অম্বায়ই খোদাইয়া দিল? হাসুকে দিয়া অহনই আবার পাড়াইয়া দিমু।
শফির মা আসে। কথার আগা-গোড়া না শুনেই শুরু করে—পুরুষের ঘরতন পলাইয়া আহে কেও? পুরুষের ঘরই মাইয়ালোকের হাপন ঘর। হেইখানে জিন্দিগী কাড়াইতে অইব। হউর-হাউরীর খেদমত করতে অইব। মরলেও হেই মাড়ি বুকের উপুর লইয়া থাকতে অইব। হেই মাড়ি ছাড়তে আছে? হেই মাড়ি কামড় দিয়া পইড়্যা থাকতে অয়।
মায়মুনের মুখের দিকে চেয়ে দেখে জয়গুন। আসহায় চোখ দুটো টলটল করছে, করুণা ভিক্ষা করছে তার কাছে।
এবার মায়মনের ওপরের সমস্ত রাগ জয়গুন শফির মা-র ওপর ঢালে। সে বলে—থাউক, থাউক। আর বকরবকর কইর্য না। তুমি বুড়া অইছ বাতাসে। তোমার কথায় মাডি খাইছি আমি। অমন বুইড়া জামাইর কাছে মাইয়া না দিয়া কুচি কুচি কইর্যা কাইট্যা গাঙ্গে ভাসাইয়া দেওয়ন ভাল আছিল। আমার বাড়ী থাকতে ও এমুন আছিল? প্যাট ভইরা ভাত খাইতে না পারলেও, এই রকম হকনা কাষ্ট আছিল না।
শফির মা মায়মুনকে জিজ্ঞেস করে—তোর হাউরী প্যাট ভইর্যা তোরে খাইতে দেয় নাই, মায়মুন?
—এই দুই মুঠ ভাত দিয়া কইত—নে, খাইয়া ওঠ বউ। দিনকাল ভালা না। প্যাট উনা থাকলে কোন ব্যারাম-আজার আইতে পারে না।
—অ্যাঁহ-হ্যাঁ-হ্যাঁ। কাসুর মা বাড়ীতে আছ?
গলা খাঁকারি দিয়ে সাদেক মিয়া সকলের সামনে এসে দাঁড়ায়।
জয়গুন মাথায় কাপড়ের আঁচল টেনে দেয়। শফির মা জিজ্ঞেস করে—কি খবর সাদেক মিয়া?
—খবর বেশী ভালা না। কাসুর খুব অসুখ। যহন-তহন অবস্থা।
জয়গুন চমকে ওঠে। তার পায়ের নিচের মাটি সরে যাচ্ছে। দুনিয়াটা অন্ধকার ঠেকছে চোখে। ঘোমটার নিচে অস্ফুট প্রতিধ্বনি হয়-কাসুর অসুখ! যহন-তহন অবস্থা।
—বেহাল অবস্থা। করিম ভাই আমারে পাড়াইয়া দিছে, তোমারে নিতে। দেরী অইলে–
সাদেক মিয়ার মুখ দিয়ে কথার শেষটা বের হয় না।
কাসুর শয্যা-পার্শ্বে দু’জন মৌলবী অনর্গল দোয়া-কালাম পড়ে চলেছেন। মাঝে মাঝে করিম বকশের কথার নিচে তাদের স্বর চাপা পড়ে যায়। তার আকুল আবেদন কান্নার মত বেরিয়ে আসে—আল্লা, তুমি আমার কাসুরে বাঁচাও। তুমি জান-মালের মালিক। ওর জানের বদলে দুইডা জান সদকা দিমু। তুমি ওরে বাঁচাও ওর জানের বদলে দুইডা খাসি সদকা দিমু। আল্লা, আল্লা, তুমি রহমান, তুমি রহিম। তুমি বাঁচানেওলা। তুমি–
লম্বা ঘোমটা টেনে জয়গুন দরজার পাশে এসে দাঁড়ায়। তার পিছনে হাসু ও শফির মা-কে দেখে করিম বক্শ বুঝতে পারে, জয়গুন এসেছে। করিম বক্শ মৌলবী দু’জনকে ইশারায় সরে যেতে বলে নিজেও বেরিয়ে যায়।
জয়গুন কাসুর বিছানার পাশে বসে ডাকে—কাসু, কাসু আমার সোনামণি।
শফির মা, শফি, হাসু ও মায়মুন বিছানার দুই পাশে বসে। আঞ্জুমনও আসে। তাদের সকলের মাথা ঝুঁকে থাকে কাসুর মুখের ওপর।
শফির মা বলে—চাইয়া দ্যাখ কাসু। তোর মা আইছে।
কাসু কোন সাড়া দেয় না। চোখ দুটো আধবোজা। মাথাটা কখনও সোজা হয়, কখনও এ-পাশে ও-পাশে হেলে পড়ে। তার নিশ্চল হাত পা ছড়িয়ে আছে লম্বা হয়ে। অনিয়মিত নিশ্বাস-প্রশ্বাসে বুকের ওপরের কথাটা দুলে ওঠে। বুকের ওপর কান পেতে কফের ঘ্যাড় ঘ্যাড় শব্দ শোনা যায়।
জয়গুন আবার ডাকে—কাসু, বাজান একবার চউখ মেইল্যা দ্যাখ।
করিম বক্শ ডেকে বলে–কাসু, চাইয়া দ্যাখ তোর মা আইছে।
কাসুর মাথাটা বাম কাত থেকে ডান কাত হয় শুধু। কোন সাড়া পাওয়া যায় না।
আঞ্জুমন বলে—দুই দিন আগেও টাস টাস কতা কইছে। দুই দিন ধইরা জব বন্ধ। কত ফকির-কবিরাজ, কত কত পানি পড়া, তাবিজ-তুমার! কিছুতেই কিছু অইল না। যে যা কইছে কোন তিরুডি অয় নাই। অহন আল্লার আতে সপর্দ। অউয়ত-মউয়ত আল্লার আত। আল্লায় যদি মোখের দিকে চায়। – করিম বক্শ দোর গোড়া থেকে বলে—আল্লা যদি কাসুরে দুইন্যায় রাইখ্যা যায়, তয় আমি জমিনের উপরে খাড়াইয়া মানতি করলাম, কাসুর একটা জানের বদলে দুইডা খাসি জবাই কইর্যা তার গোশত গরীব মিসকিনরে বিলাইয়া দিমু। কাসুরে আজমীরশরীফ খাজা বাবার দরগায় লইয়া যাইমু।
জয়গুনের চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছে অবিরল ধারায়। হৃদয়ভেদী কান্নার বেগ চেপে রাখতে গিয়ে তার স্বর ভেঙে যায়। ভাঙা গলায় সে আমিনকে বলে—দুইডা দিন আগেও যদি আমারে খবর দিত। ওর মোখের কথা হুইন্যা মনেরে বুঝ দিতে পারতাম। ওর ‘মা-মা’ ডাক হুইন্যা পরাণ শীতল করতাম।
একটু থেমে আবার বলে—তোমরা ডাকতর দেহাইছিলা?
—ডাকতর কি করব? কত ফকির হট খাইয়া গেল!
অন্ধকারের মধ্যে জয়গান আলো খুঁজে বেড়ায়। নিরাশার মধ্যেও আশা চেপে ধরে বুকে। ঝড়-ঝঞ্ঝার মধ্যেও সে হাল ছেড়ে দেয় না।
হাসুকে সে নির্দেশ দেয়—হাসু, যা। জগদীশ ডাকতর না অয় আর কোনো ডাকতর জলদি কইর্যা লইয়া আয়। পথে দেরী করিস না। বলেই সে মনে মনে চিন্তা করে, ডাক্তার এলে টাকা দিতে হবে। কিন্তু কোথায় টাকা?
জয়গুন এবার শফিকে বলে—তুই বাড়ীত যা। বড় আঁস দুইডা বাজারে লইয়া যা। বেইচ্যা টাকা লইয়া চালাক কইরা আবি। কিন্তু দুইডা আসে কত পাওয়া যাইব! বড় জোর দুই টাকা।
মায়মুন বলে—আমার আঁস দুইডাও লইয়া যাইও, শফি ভাই। আমাগ কাসু বাঁচলে কত আঁস পাওয়া যাইব আবার।
জয়গুন বলে—হ, চাইড্যা আঁসই লইয়া যায়।