সোলেমান খাঁ মনোযোগ দিয়ে শোনে। তারপর বলে মানুষ ত তিন আঙুল। এত ভাত রাখে কই?
কে জানে কই রাখে? আমার মনে অয় গলার তন পাও পর্যন্ত বেবাকখানি ওর প্যাট। এমুন হাবাইত্যা ঘরের মাইয়া বেশী দিন ভাত-কাপোড় দিয়া রাখলে তোমারে আর বিচরাইয়া পাওয়া যাইব না—তালুক-মুলুক বেচতে অইব।
সোলেমান খাঁ নিচের ঠোঁটটা দাঁত দিয়ে চেপে ধরে। গালে হাত দিয়ে গভীর মনোযোগের সঙ্গে মাথা নেড়ে বলে—আমার মনে লয়, তোমার কথাই খাডি। পেত্নীর দিষ্টি আছে। পেত্নী ওর লগে খায় বুইল্যাই না এত ভাত লাগে।
সোলেমান খাঁ-র স্ত্রী আবার বলে—হোন কই, এই রাকস রাহনের কাম নাই। হেদিন ওসমানের ঘরে দিছিলাম। শরমেরও কত। রাইতে হেই কি চিক্কইর! আর এট্ট অইলে চৌদ্দ বাড়ীর মানু একখানে কইরা লইত? ছিঃ ছিঃ! অ-ঘিন, অ-ঘিন। বোঝলাম, এইডা জুয়ান অইতে অইতে আমার ওসমান ঠণ্ডা অইয়া যাইব। আর এদ্দিন তক্ত বহাইয়া। খাওয়াইলে ফউত অইয়া যাইবা, কইয়া রাখলাম। কমসে কম তিন খান বচ্ছর ত লাগব লায়েক অইতে।
-কি করতে চাও ত?
–আমি কই, ওরে ওর মা-র কাছে পাইয়া দ্যাও। মা-রড খাইয়া বড় অউক। জেরে দাহা যাইব।
সোলেমান খাঁ সব শুনে এবার রায় দেয়——ওরে ওর মার কাছেই পাড়াইয়া দ্যাও। আমি আবার ওসমানের শাদী দিমু।
—গয়নাগুলা?
—খুইল্যা রাখবা। ওসমানের বিয়া দিতে লাগব তো। আবার জোড়ায় জোড়ায় গয়না বানাইমু, ট্যাকা কই? টাকা কি গাছের গোড়া যে, ঝুল দিলেই পড়ে? খালি গয়না কী, কাপোড় দুইডাও রাইখ্যা দিবা। কয়মাস আগে কিনছি। অহনও দুই ধোপ পড়ে নাই। এই কাপোড় আর গয়না দিয়া হাজাইয়া নতুন বউ ঘরে আনমু।
তারপর একদিন হাসু ও শফি আসে মায়মুনকে দেখতে। মায়মুনের শাশুড়ী, দুটি ননদ ও ছোট্ট একটি দেবর একটা চাঙারির চারপাশে চক্রাকারে বসে কাঁচা মটরশুটি ছাড়াচ্ছিল। মানুষ আসার শব্দ পেয়ে মায়মুনের শাশুড়ী একবার তাকায়। তারপর মাথায় আঁচল টেনে আবার মটরের দানা বাছতে শুরু করে।
হাসু ও শফি পরস্পর মুখের দিকে তাকায়। এ রকম অবজ্ঞা ও অবহেলার কি কারণ থাকতে পারে, তারা ভেবে পায় না। হাসু জিজ্ঞেস করে–কেমুন আছেন মাঐ সা’ব? মায়মন কই?
উত্তর দেয় মায়মুনের ছোট ননদ, গাঙ্গের ঘাডে পানি আনতে গেছে। তার মুখের কথা। শেষ না হতেই মায়মুন আসে। কাঁখের কলসীটা ছোট। তবুও তার ভারে মায়মুন সোজা হয়ে হাঁটতে পারে না। কোমর বেঁকিয়ে খোড়ার মত পা ফেলতে ফেলতে সে আসে। হাঁসু ও শফিকে দেখতে পেয়ে খুশীতে ভরে ওঠে। সে পানির কলসীটা রান্না ঘরে রেখে ছুটে আসে। হাসুর একটা হাত ধরে বলে—মিয়াভাই গো, কোনসুম আইলা?
–এইত আইলাম।
–আমি যাইতাম তোমার লগে।
জরিনা বিবি অথাৎ মায়মুনের শাশুড়ী এবার ফোঁস করে ওঠে—হ, যাও ভাইর লগে অহনই চইলা যাও। হ হাশেম মিয়া, তোমায় আললাদি বইনগারে আইজই লইয়া যাও। আমরা আর রাখতে চাই না।
–কি অইছে মাত্র? কোন দোষ করছে মায়মুন?
—না বাপু, অমুন ঝিরকুইট্যা বউ দিয়া আমাগ চলব না। কই গেলি ওসমান? কি কইছিলাম?
জরিনা বিবি ঘরে যায় ওসমানের কাছে। আস্তে আস্তে বলে—গয়না গুলা খুইল্যা রাখ। পিন্দনের কপোড়ডা রাইখ্যা এট্টা ছিঁড়া কাপোড় দিয়া দে! ওড়া পিন্দা কোন রহমে শরম বাঁচাইয়া আতে পায়ে যাউকগা ভাইর লগে।
ওসমানের চোখে-মুখে অক্ষমতা ফুটে ওঠে। হাসু ও শফির উপস্থিতিতে এ কাজ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। সে বলে—তুমি দ্যাও গিয়া। আমার শরম করে।
—আহা, আমার নতুন বউ রে! অত যদি শরম, তয় ঘোমডা দিয়া ঘরে বইয়া থাক। তোরা মরদ অইছিলি কোন দুকখে? আমি মাইয়া মানুষ। পারি কিনা-পারি দ্যাখ চউখ মেইল্যা!
জরিনা বিবি দুই গোত্তা দিয়ে দু’পা এগুতেই ওসমান বাধা দেয়—মা, মা, হোন। ওরা আইজ যাউকগা। পরশু তরশু আইয়া যেন লইয়া যায়।
জরিনা বিবি দরজার ওপর দাঁড়িয়ে যায়। ওসমানের দিকে ফিরে বলে—আইচ্ছা, কইয়া দেই।
তারপর ঘর থেকে নিচে নেমে হাসু ও শফির দিকে চেয়ে বলে—হোন বাপু। কাইল পরশু আইয়া তোমাগ বইনেরে লইয়া যাইও।
হাসু বলে—বিষয় কি? কি অইছে মাঐ?
—কিচ্ছুই অয় নাই মিয়া। যা কই মনে থাকে যেন।
শফি হাসুর দিকে চেয়ে বলে—আইজই মায়মুনেরে লইয়া যাই।
—না, আইজ থাউক। মা-র কাছে জিগাইয়া দেহি, যদি নিতে কয়, তয় লইয়া যাইমু। হাসুর কথা শুনতে পেয়ে জরিনা বিবি বলে—মা-র কাছে আর হোনতে অইব না বাপু। তোমার মা মানা করত না। কাইল আইয়া লইয়া যাইও।
-আইচ্ছা।
এই ‘আইচ্ছা’ বলে যে হাসু চলে গেল আর হাসুর দেখা নেই। জরিনা বিবি নিজেই মায়মুনের গায়ের গয়না খুলে একটা ছেঁড়া কাপড় পরিয়ে তাকে তৈরী করে রেখেছে। তিন দিনের দিনও যখন কেউ এসে নিয়ে গেল না, তখন তার পরের দিন ভোরবেলা জরিনা বিবি নিজেই মায়মুনের হাত ধরে বাড়ীর নিচের মটর খেতের পাশে এনে ছেড়ে দেয়।
তাদের পেছনে মায়মুনের দুটি ননদও এসে দাঁড়ায়।
দূরে সুর্য-দীঘল বাড়ীর তালগাছটা দেখিয়ে জরিনা বিবি বলে—ঐ তালগাছটা বরাবর চইল্যা যাও। খোদায় যদি তোমার কপালে এই বাড়ীর ভাত লেইখ্যা থাকে তো আবার আইও, অহন মা-র বুকের দুধ খাইয়া মোটা তাজা অও গিয়া।
—আমি একলা যাইমু? মায়মুন জরিনা বিবির মুখের দিকে তাকায়।
—একলা যাইবা না তো দোকলা পাইবা কই? যাও। তোমার রূপ বাইয়া বাইয়া পড়ে না সোনা। পথের মাইনষে ধইর্যা লইয়া যাইব না।
মায়মুন যেন কারাগার থেকে খালাস পেয়ে এল। তার আনন্দই হয়। আর সে আনন্দ বেড়ে যায় প্রত্যেক পদক্ষেপে। পেছনে তাকাতেও তার ভয় হয়।