পাশের ঘরে কাসু থেকে থেকে প্রলাপ বকছে। ফকির আবার বলে—
শোনরে ভাই ল্যাজফটকা, রাখ বাজে কথা,
বাঁচতে চাইলে উড়াল দে যথা ইচ্ছা তথা।
হাঁরে—হাঁই-হুম-হাঁই-হুম-হাঁই।
এই বাড়ী ছাইড়া যদি না যাস চলে,
লোয়া পুইড়্যা লাল কইর্যা ছেঁকা দিমু গালে।
হাঁরে—হাঁই-হুম-হাঁই-হুম-হাঁই।
ভূত বলে—
তোর মতন ফকিরের রাখি কিরে ডর?
কত ফকির ভাইগ্যা গেল খাইয়া থাপ্পর।
হাঁরে—হাঁই-হুম-হাঁই-হুম-হাঁই।
বিছানার ওপর দুই হাতের থাপ্পড় মেরে ফকির বিকট চিৎকার করে–
তয়রে হারামজাদা বইস্যা থাক সোজা,
পাগলা দিদার মন্তর ঝাড়ব বুঝবি এহন মজা।
কই গেলিরে ল্যাৰা ভূত, কই গেলিরে ট্যাবা,
কই গেলি কাইল্যা ঠ্যাড়া, কই গেলিরে খ্যাবা,
সমদ্দুরের ফেনা আইন্যা–
ভূত এবার ভয়ে আর্তনাদ করে ওঠে। দুই হাতে ফকিরের পা জড়িয়ে ধরে বলে—না, না, না। আমি এহনি চইল্যা যাই। সব্বনাশ কইর্য না আমার। বাপ্পুস রে!
—হ, অহনি চইল্যা যা। দেরেং করলে বোতলের মইদ্যে আটকাইয়া ফ্যালাইমু, কইয়া। দিলাম হেই কতা।
—তুমি আমার মনিব। আমি তোমার নফর। যাওনের আগে একটা ভোগ দ্যাও।
–কিয়ের ভোগ?
—আড়াই গণ্ডা শবরীকেলা, মিহিন চাউলের ভাত
সেরেক পাঁচেক মাইপ্যা দিও কাইট্যা কেলার পাত।
ঝাল-ছাড়া নুন-ছাড়া পোড়া গজার মাছ,
রাইখ্যা দিও এইগুলা যেথায় তেঁতুল গাছ।
ফকির বলে—আইচ্ছা, আইচ্ছা, দিমু। তুই অহন পলা।
অন্ধকারের মধ্যে ঘরের চালাটা আবার কড়কড় করে ওঠে।
বাতি জ্বালাতেই দেখা যায়, ফকিরের শাগরেদ বিছানার ওপর বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে। ফকির ও তার অন্যান্য শাগরেদ ছাড়া আর সবার মুখ ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে ওঠে।
ফকির এবার পানিতে হাত ভিজিয়ে শাগরেদের গায়ের ওপর ছিঁটিয়ে দেয়। শাগরেদ লাফ দিয়ে ওঠে।
ফকির আড়ামোড়া ভেঙে শাগরেদকে জিজ্ঞেস করে—কিরে, কই আছিলি এতক্ষুণ?
—ঘুমাইয়া পড়ছিলাম।
ফকির মাথা নাড়ে আর গোঁফের তলা দিয়ে হাসে।
করিম বক্শ বলে—ঘুমাইছিলা! আর তোমার উপরে এত তফরখানা গেল!
ফকির অভিভাবকের মত বলে—থাউক, থাউক, ওয়া নিয়া আর মাথা ঘামাইয়া কাম নাই। হোন করিম বক্শ, কামডা খুব সহজে অইয়া গেল। ওরে ওই হগল খাইতে দিলেই ও চইল্যা যাইব। কাইলই বাজার তন গজার মাছ, কেলা আর চিনিগুড়া চাউল আইন্যা আমার কাছে দিও। তেতুল গাছের গোড়ায় আমিই রাইখ্যা আসমু ঠিক রাইত দুপুরের সুময়। তোমাগ যেই ডর! তোমার উপরে এই কাম ছাইড্যা দিতে ভস্সা পাই না।
একটু থেমে আবার সে বলে—ভুত ছাইড়া গেলে কাসুরে গোসল করাইয়া পাক-সাফ করতে অইব।
—গোসল! এই জ্বরের মইদ্যে?
–-হ, হ। জ্বর কুথায় দ্যাখছ তুমি? এইডাও জান না, ওরা আগুনের তৈয়ারী? আমাগ মতন মাডির তৈয়ারী না। ঘেড়ির উপরে চাইপ্যা থাকলে শরীল গরম না অইয়া যায়? পরশু বিহানে মোরগের বাকের আগে কাসুরে রাস্তার তেমাথায় নিয়া গোসল করাইতে অইব। তুমি সাত পুকুরের পানির যোগাড় রাইখ্য। সাত ঘাডের না কিন্তুক। এক পুকুরেরও সাতখান ঘাড থাকতে পারে। সাত পুকুরের পানি অওয়ন চাই।
১৬. মায়মুন শ্বশুর বাড়ী থেকে চলে এসেছে
মায়মুন শ্বশুর বাড়ী থেকে চলে এসেছে। জয়গুন রাগে ফেটে পড়ে। কঠিন স্বরে জেরা করতে আরম্ভ করে—না কইয়া পলাইয়া আলি ক্যাঁ? এহন মাইনষে হুনলে ঝাটা মারব মোখে।
—পলাইয়া আহি নাই মা। খেদাইয়া দিছে।
—খেদাইয়া দিছে!
—হ, দ্যাহ না আমার নাক-কান খালি। গয়নাগুলা খুইল্যা নিছে। পিন্দনের কাপড় রাইখ্যা এই ছিঁড়া কাপড় দিছে।
কৈফিয়তে জয়গুনের রাগ নামে। ব্যাপারটার কিছু কিছু সে হাসুর কাছে শুনেছিল সেদিন। কিন্তু তার শাশুড়ীর এরূপ আচরণের কোন কারণ হাসু বলতে পারেনি। সেও ভেবে পায় না। জয়গুন আবার জেরা করে–কি দোষ করছিলি? ক’ শীগগীর।
—কিচ্ছু দোষ করি নাই, মা। মায়মুনকে শ্বশুর বাড়ীর কেউ পছন্দ করেনি। সোলেমান খাঁও না। কিন্তু অপছন্দের কথা সে কখনও মুখ ফুটে বলতে পারেনি। কারণ সে নিজেই দেখেশুনে ছেলের জন্যে বউ পছন্দ করেছিল।
মায়মুন যেদিন প্রথম শ্বশুর বাড়ী আসে, সেদিনই তার শ্বশুর-শাশুড়ীর মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়।
শাশুড়ী বলে—তুমি কি চউখের মাথা খাইয়া বউ দেখছিলা? এই রহম জালি বউ দেইখ্যা-হুইন্যা আনে কেও? এহন ভাত কাপড় দিয়া পালতে অইব।
—জালি কোহানে দ্যাখছ তুমি? এক্কেরে ঝুনা নাইকল।
—হ, ঝুনা না আরও কিছু। ও না পারব ওসমানের ঘর করতে, না পারব এক কলসী পানি আনতে। দুই ঠ্যাং লইয়া টেকির উপরে ওঠলেও কথা হোন না ঢেঁকি! দুই সের চাউলের ভাতের আঁড়ি উডাইতে গেলে ফেলাইয়া দিব। তহন ভাতও যাইব, আঁড়িও যাইব।
সোলেমান খাঁ কথাগুলোর গুরুত্ব বুঝতে পারে। কিন্তু নিজের কৃতকর্মের জন্যে স্ত্রীর কাছে সে হার মানতে রাজী নয়। সে স্ত্রীকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে বলে—তুমি কিছু চিন্তা কইর না। হবায় বিয়ার পানি পাইছে। দুই মাসের মইদ্যেই দ্যাখবা বউ আমাগ লায়েক অইছে।
কিন্তু দিন পেরিয়ে যাচ্ছে। মায়মুন তার শ্বশুর-শাশুড়ীর চোখের সামনে তাদের ইচ্ছেমত বড়সড় হয়ে উঠল না। যেমন ছিল, তেমনটি রয়ে গেল। শাশুড়ীর রাগ ধরে—কেন সে ভোমরায় আল দেওয়া কদুর মত ঝিম ধরে থাকল, কেন হাতে-পায়ে বড় হয়ে উঠল না।
সোলেমান খাঁর এজলাসে প্রায়ই এ ব্যাপারে শুনানি হতে থাকে। একদিন সোলেমান খাঁর স্ত্রী বলে—ভাত খাইতে ত কম খায় না। আমাগ দুনা ভাত খায়। যদি জিগাই আর নিবি বউ? তয় কোন দিন ‘না’ করব না। আঁসের মতন গলা–সমান খাইয়া টাববুস অইয়া তারপর উঠব। এত খাওয়া ত’ বড় অয়নের নাম নাই। আর অইবই বা কেমনে। সুর্য-দীগল বাড়ীর মাইয়া। পরাণ লইয়া বাঁইচ্যা আছে, এই কালের ভাইগ্য। তোমারে হেইসুম কত কইর্যা যে কইলাম, সূর্য-দীগল বাড়ীর মাইয়া আননের কাম নাই। হেইয়া হোনলা না। মাইয়ার উপরে পেত্নীর দিষ্টি না আছে ত কি কইলাম।