করিম বক্শ কাসুর মাথায় কপালে হাত দিয়ে দেখে। হাত রাখা যায় না। মনে হয়, পুড়ে যাবে হাত।
—মা, মা, মাগো মা।
করিম বক্শ বলে—ম্যাও ম্যাও করস ক্যাঁ? আল্লা আল্লা কর। আল্লায় রহম করব।
কাসুর হুঁশ নেই। সে কখনও বিড় বিড় করে, কখনও বা টানিয়ে টানিয়ে প্রলাপ বকতে থাকে।
করিম বক্শ উদ্বিগ্ন হয়। সে তাড়াতাড়ি করে ফকির বাড়ী যায়। গ্রামের সেরা ফকির দিদার বক্শ এসে হাতের লাঠিটা বেড়ার সাথে ঠেকিয়ে রেখে কাসুর বিছানার পাশে বসে।
কাসু প্রলাপ বকছে—ওইডা কি? তেঁতুল গাছ!
কিছুক্ষণ বসে থেকে দিদার বক্শ চোখ বুজে ওপরের দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটে চাপ দিয়ে বিজ্ঞের মত কয়েকবার মাথা নাড়ে। তারপর গাম্ভীর্যের সাথে বলে—আর দ্যাখতে অইব না। মোখ দেইখ্যা আগেই আমি বোঝতে পারছি।
করিম বক্শ উদ্বেগভরা কণ্ঠে বলে-কি, পাগল ভাই?
দিদার বক্শকে সবাই পাগলা দিদার বলে।
সে বলে—আবার কি! কথা হুইন্যাও মালুম করতে পার না? দ্যাহ না কেন বিলকি-ছিলকি কয়?
—আমিও আগেই মালুম করছি কিছু। সব সময় খালি কয় গোঙাবুড়ী আইল। গলা টিপ্পা ধরল। আল্লা খোদার নাম নাই মোখে। আর কেবল ম্যাও ম্যাও করে। আমার দাদার মোখে হুনছি, ভূতে পাওয়া মানু আল্লার নাম ভুইল্যা যায়। এহন কি করা যায়, পাগল—ভাই?
—কিছু চিন্তা নাই! হোন, একখান ন্যাকড়া লইয়া আহ। আর এক চামুচ কডুতেল।
ফকিরের নির্দেশ মত করিম বক্শ ন্যাকড়া ও সর্ষের তেল নিয়ে আসে। ন্যাকড়া দিয়ে। দড়ি পাকিয়ে ফকির তার এক প্রান্ত ডুবিয়ে ধরে তেল-ভরা ঝিনুকের মধ্যে। তারপর বাতির শিখার ওপর দড়ির তেল-মাখন মাথাটা পোড়া দেয়। দড়ির প্রান্ত থেকে যখন ধোঁয়া বেরুতে শুরু করে, তখন ফকির কুণ্ডলায়িত ধোঁয়াসহ গরম প্রান্তটা কাসুর নাকের মধ্যে বারবার প্রবেশ করিয়ে দেয়। কাসু যন্ত্রণায় উঃ করে ওঠে প্রত্যেক বার। তার কোমরটা বিছানা ছেড়ে উঁচু হয়ে ওঠে। শক্তি নিঃশেষ করে হাঁচি দেয় কয়েক বার।
মুখে হাসি টেনে ফকির বলে—আঁচি দিছে, আর চিন্তা নাই। এই অ্যাঁচির ঠেলায় আলাই-বালাই পলাইব। যদি একে না-ই পলায়, তয় মাগরিবের ওক্তে একবার খবর দিও। আইজ রাতেই বৈডক দিমু। হেইখানে বোলাইয়া ওর চৌদ্দ-গোষ্ঠির ছেরাদ্দ করুম। ভালয় ভালয় যদি না যায় তো ওস্তাদ শেখ ফরিদের নাম লইয়া এমুন মন্তর ঝাড়, যার তেজে সুড় সুড় কইর্যা আমার বোতলের মইদ্যে ঢুকব। আমি তহন চট কইর্যা বোতলের মোখ বন্ধ কইরা দিমু। তারপর আমার শিথানের নিচে মাড়িতে গর্ত কইর্যা বোতলডা উপড় কইর্যা বহাইয়া মাড়ি দিয়া ঢাইক্যা দিমু। আমার শিথানের নিচে কি একটা দুইডা! এই রহম কত ভূত-পেত্নী, দানা-পিচাশ জিন-আত কবর দিয়া থুইছি, লেখাজোখা নাই। কিন্তুক জাহিলগুলার মউয়ত নাই। রাইতে যহন বালিশে মাথা রাখি, তহন কত কান্দা-কাড়ি! কয়—আর কোন দিন আদমজাতের ক্ষেতি করতাম না। একবার ছাইড়্যা। দ্যাও। তোমার গোলাম অইয়া থাক। তোমারে পাকিস্তান জয় কইরা দিমু, পাকিস্তানের রাজা বানাইমু। আমিও কই—আমি রাজা অইতে চাই না। তোরা রোজকিয়ামত পর্যন্ত বোতলের মইদ্যে থাকবি। গোলমাল করলে উফায় নাই।
করিম বক্শ শোনে মনোযোগ দিয়ে। ফকিরের গল্প শুনে সে বিস্ময়ে হতবাক। একটা কুলোয় করে সে সোয়া সের চাল আর সোয়া পাঁচ আনা পয়সা এনে ফকিরের পায়ের কাছে রেখে দেয়।
রাত বারোটার পর বৈঠক। মোমবাতি-আগরবাতি জ্বালিয়ে লোকজন ও শাগরেদসহ দিদার বক্শ ফকির ‘ভারানে’ বসে!
আগেই সে জিজ্ঞেস করে—কার উপরে চালান দিমু, করিম বক্শ? তোমার উপরে?
—আমার উপরে! না—না—না খবরদার ভাই, খবরদার! আমার ডর করে।
—ভর করলে চলব ক্যাঁ? তোমার উপরে ত আর চিরজনম ভর অইয়া থাকব না। আমার কাম অইয়া গেলে আবার নামাইয়া দিমু।
—না! আর কেওরে কইয়া দ্যাহেন।
—কে আছে আর? রুস্তম, তুমি? সাদেক? হারুন? কিছু ভর নাই। এক্কেরে পান্তাভাত।
সবাই মাথা নেড়ে অস্বীকার করে! শেষে ফকির তার এক শাগরেদকে ঠিক করে। তার ওপরেই ভর করবে ভূত।
দিদার বক্শ মোমবাতি নিবিয়ে দিয়ে সবাইকে সাবধান করে দেয়— খবরদার, কেও চউখ উপর দিক কইর্য না! ভূতের চউখে চউখ পড়লে তোমাগ চউখ গইল্যা পানি অইয়া
ফকির এবার বাবরি চুল নাচিয়ে গলার মধ্যে কেমন ফাস ফাস শব্দ করে ‘জিকির’ আরম্ভ করে।
এক সময়ে ঘরের চালার ওপর ঢিল পড়তে শুরু করে।
ফকির বলে—চাইশা মারস ক্যাঁ? পিড়পিড়াইয়া ঘরে আয়। ঘরে আইতে অইবই।
কিছুক্ষণ পরে ঘরের চালাটা কড়কড় করে ওঠে। সাথে সাথে ফকিরের চেলাটিও দুলতে আরম্ভ করে আর গলার ভেতর অদ্ভুত ফ্যাঁস ফ্যাঁস শব্দ করে—হ্যাঁরে—হাঁই—হুম।
সবাই বুঝতে পারে, ওর ওপরে ভূত ভর করেছে। দিদার বক্শ এবার টানা সুরে বলতে আরম্ভ করে–
আমার নাম দিদার বক্শ শুইন্য মন দিয়া
আমার নামে ভূত-পত্নী সবাইর কাঁপে হিয়া!
শেখ ফরিদের নাম লইয়া যদি মন্তর ঝাড়ি,
হাজার গণ্ডা ভূত-পেত্নী ভেন্টাইবার পারি।
হ্যাঁরে—হাঁই-হুম-হাঁই-হুম-হাঁই।
তোমার লেইগ্যা বইস্যা আছি, কও তোমার নাম।
কিবা জাত, কিবা গোত, কোন খানেতে ধাম?
হ্যাঁরে—হাঁই-হুম-হাঁই-হুম-হাঁই।
শাগরেদের ওপর চালান-দেওয়া ভূত বলে—
আমার নাম ল্যাজফটকা থাকি ডালে ডালে,
কাচ্চা-বাচ্চা পাই যদি ভরি দুই গালে।
সিয়ানা অইলে তার কান্ধে চইড়্যা বসি,
লহু মাংস শুষে খাই সারা দেহ চষি।
হাঁরে—হাঁই-হুম-হাঁই-হুম-হাঁই।
রুস্তম অন্ধকারের মধ্যে বাম হাত চালিয়ে পাশের সাদেকের পিঠে চাপ দেয়। উদ্দেশ্য, সাদেকের মনে এ ব্যাপারে আরো বেশী বিস্ময় জাগিয়ে তোলা। সাদেক কাঁপছে থরথর করে। তার রক্তও বুঝি হিম হয়ে যায়।