একটু থেমে আবার বলে—আমার কাম যদি ফতে অয়, তয় তোরে একখান গামছা কিন্যা দিমু!
করিম বক্শ সন্ধ্যার সময় কাসুর কোমরের দড়ির বন্ধন খুলে দেয়। কড়া পাক-দেওয়া গরুর দড়িটার দাগ বসে গেছে কোমরে। করিম বক্শ আদর করে ডাকে—কাসু অ-কাশেম! চল্ বাজান, তোরে টিয়াপক্ষীর বাচ্চা ধইরা দিমু। ওই তেঁতুল গাছে টিয়ার বাসা আছে।
কাসু উৎফুল্ল হয়ে ওঠে।
—চল আমার লগে।
করিম বক্শ কাসুর হাত ধরে তেঁতুল গাছের দিকে নিয়ে যায়। পথে যেতে যেতে করিম বক্শ বলে—আমারে বাজান কইয়া ডাক দে।
দীর্ঘ চার বছর কাসু ফুফুর বাড়ীতে কাটিয়েছে। কেউ তাকে ঐ নামে ডাকতে শেখায়নি! অনভ্যস্ত বলে এখন বাজান ডাকতে কাসুর লজ্জা হয়। বাপের কাছে এসে সে আদর-স্নেহ যা পেয়েছে, তার চেয়ে মারধর খেয়েছে ঢের বেশী। করিম বক্শ ছেলের কাছে পিতার উপযোগী কোন ভক্তি-শ্রদ্ধাই অর্জন করতে পারেনি। সে যা অর্জন করেছে তা ভয়। কিছুটা ভয় আর বেশীর ভাগই লজ্জায় কাসু বাজান বলে ডাকতে পারে না। এ জন্য কতদিন মারও খেয়েছে। মার খেয়ে অনিচ্ছায় উচ্চারণ করেছে কয়েক বার। কিন্তু মুখ দিয়ে স্বতঃস্ফুর্ত হয়ে শব্দটি কোনদিন বের হয়নি।
করিম বক্শ আবার বলে…কিরে, ক। না কইলে টিয়াপক্ষীর বাচ্চা দিম না।
এত লোভ দেখানো সত্ত্বেও কাসু মুখ বুজে থাকে। কোন কথাই বের হয় না মুখ দিয়ে। করিম বক্শ আর পীড়াপীড়ি করে না।।
তেঁতুল গাছের কাছাকাছি যেতেই কি রকম এক গোঙানির শব্দ শুনে কাসু থমকে দাঁড়ায়।
করিম বক্শ বলে—কিরে, কি অইল?
—অইডা কি দোহা যায়? তেতুল গাছের টিকিতে বইয়া রইছে! করিম বক্শ কৃত্রিম বিস্ময় প্রকাশ করে বলে—সত্যই ত! পাকনা চুল ছাইড়া বইয়া রইছে! আবার গোঙায়!
করিম বক্শ চোখ দুটো বড় করে বলে-খাড়া, দেইখ্যা লই।
কাসু এবার করিম বকশের হাত ধরে তার গায়ের সাথে মিশে দাঁড়ায়। করিম বক্শ কাসুকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে।
—কাসু, শিগগির আমার কোলে ওঠ। বাপরে বাপ! এইডা ত আর কিছু না! এইডা যে। গোঙাবুড়ি! গলা টিপ্যা ধরব! আল্লা! আল্লা, বাঁচাও! আল্লা, আল্লা! কাসু, আল্লার নাম কর। আল্লা, আল্লা।
কাসু করিম বকশের বুকের মধ্যে মুখ লুকায়। ভয়ে চোখ বন্ধ করে। কাঁপে থরথর করে। করিম বক্শ কাসুকে কোলে নিয়ে দৌড় দেয়। বাড়ী এসেও কাসু চোখ খোলে না।
রাত্রে শুয়ে শুয়ে করিম বক্শ বলে—কাসু, আমারে বাজান কইয়া ডাক দে। বা’জান না ডাকলে গোঙাবুড়ী বোলাইমু।
অন্ধকারের মধ্যে শিউরে ওঠে কাসু। করিম বক্শকে জড়িয়ে ধরে দুই হাতে। তার চোখের সামনে তখনও যেন সে দেখছে গোঙাবুড়ীর বিকট মূর্তি।
করিম বক্শ কাসুকে দূরে সরিয়ে দেয়ার ভান করে বলে—সইর্যা যা আমার কাছতন। আমারে বাজান না কইলে এহনি গোঙাবুড়ী ডাক দিমু।
কাসুর ভীত-কম্পিত কণ্ঠ অস্ফুট শব্দ করে–বাজান।
করিম বক্শ সাড়া দেয়। তারপর বলে—কাসু, বাড়ীর বাইরে যাইস না কিন্তুক, খবরদার! ঐ গোঙাবুড়ী গলা টিপা ধরব! তেঁতুল গাছে আরো একটা পিচাশ আছে! হেইডার নাম ছালাবুড়ী। ছালার মইদ্যে ভইরা তোর মতন ডেগা পোলা পাইলে লইয়া যায়। তারপর তেঁতুল গাছে বইস্যা রক্ত খায়।
কাসু করিম বকশের বুকের মধ্যে শিউরে ওঠে। তার কাঁপুনি করিম বক্শও অনুভব করতে পারে।
সে আবার বলে—খরদার! কানাবুড়ীর সুরত ধইর্যা ছালাবুড়ী ধইরা লইয়া যাইব।
করিম বক্শ তার অদ্ভুত ফন্দির সফলতায় মনে মনে খুশী হয়। কাসুকে বাড়ীতে রেখে এখন নিশ্চিন্তে কাজ করা যাবে। কাসু ভুলেও জয়গুনের বাড়ীর দিকে পা বাড়াবে না। কারণ পথের ওপরেই তেঁতুল গাছ। আবার ছালাবুড়ীর চেহারা নিয়ে কানা বুড়ীও এসে আর সুবিধে করতে পারবে না।
করিম বকশের মতলব হাসিল হয়েছে। কাসু এখন আর বাড়ী থেকে বের হয় না। আগে বাড়ীর উত্তর পাশটায় গিয়ে দাঁড়াত সে। সূর্য-দীঘল বাড়ীর তালগাছটার দিকে চেয়ে চেয়ে সে
অনেক সময় কাটিয়ে দিত। রোজ ঐ তালগাছটা দেখে দেখে সে তার মা-র চিন্তাটাকে তাজা করে নিত মনের মধ্যে। মা-র অভাব তাতে অসহনীয় হয়ে উঠত। তেতুল গাছে গোঙাবুড়ী দেখার পর সে আর কোনো দিকে পা বাড়ায় না।
সে কখনও ফুলির বিছানার পাশে, কখনও উঠানে, কখনও বা রান্না ঘরে তার সৎমার পাশে বসে কাটিয়ে দেয়। এমন কি গোয়াল ঘরের পাশে যেতেও এখন তার সাহস হয় না।
মা-র মধুর চিন্তা তার মনে বার বার যে ছাপ রেখে গেছে, তা কখনও মুছবার নয়। সে স্থায়ী ছাপকে এখন ভুতের বীভৎস মূর্তি যেন রাহুর মত গ্রাস করছে। গোঙাবুড়ীর গোঙানি, ছালাবুড়ীর ছালা, তাদের নখর ও দাতের এলোমেলো কল্পনা কাসুকে সব সময়ে সন্ত্রস্ত করে রাখে। কোনো ঠুংঠাং শব্দ শুনলেই সে ভয়ে অস্থির হয়। রাত্রে ঘুমের ঘোরে সে চিৎকার করে ওঠে। করিম বক্শ সে চিৎকারে সজাগ পেয়ে কাসুকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে–কিরে কাসু, অমুন করস ক্যান?
কাসু কোন উত্তর দেয় না। করিম বকশের বুকের মধ্যে গিয়েও সে কাঁপে থরথর করে।
হঠাৎ একদিন কাসুর জ্বর হয়। প্রথম দিন-দুই করিম বক্শ মোটেই গা করে না। তিন দিনের দিন বেশ তোড়জোড়ের সাথে জ্বর ওঠে। বিছানায় পড়ে পড়ে কাসু প্রলাপ বকে।
করিম বক্শ দাওয়ায় বসে মাটির ওপর আঁচড় কেটে বাকী খাজনার হিসেব করছিল। সে ঘরের মাঝে উঠে এসে বলে-কাসু, অ কাসু! কি অ্যাঁ? অমন করস ক্যাঁ?
—ছালাবুড়ী আইল! উঃ-উঃ-উঃ! না—না, বাজান কইতাম না।