বর্ষার সময় ধানগাছের রকম দেখে অনেকেই অনেক আশা করেছিল। কিন্তু সবুজ ধান যখন সোনালী রঙ ধরতে শুরু করে, তখন চাষীরা ধানের ছড়া দেখে মাথায় হাত দেয়। এক একটা ছড়ার মধ্যে চার আনা ধানই অপুষ্ট—চালশূন্য চিটে। এখানে সেখানে ধানগাছ মরে যাওয়ায় জমিগুলো টাক পড়া মাথার মত হয়ে আছে।
করিম বক্শ কয়েক ‘ঘোপ কেটে আলের ওপর এসে পা ছড়িয়ে বসে। পাশের জমি থেকে ধানকাটা রেখে লেদু মিয়া আলের দিকে আসতে আসতে বলে—ভালা কইর্যা তামুক সাজ, চাচা। একটা দম দিয়া যাই।
করিম বক্শ বাশের ডিবা হতে তামাক নিয়ে সাজতে থাকে। অদূরে বসে কাসু ধানগাছের ডগা দিয়ে বাশী তৈরী করার চেষ্টা করছে। সুর্য-দীঘল বাড়ীর তালগাছটা বেশী দুরে নয় এখান থেকে। গাছটা যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাকে।
লেদু বলে—কাসুরে এই মাথা-ফাড়া রউদের মইদ্যে লইয়া আইছ কাঁ, চাচা? ওরে বাড়ীতে রাইখ্যা আইলেই পার।
—এহন এন্টু আধটু রউদ মাথায় না নিলে অইব ক্যাঁ? নোয়াব সাইজ্যা বইয়া থাকলে ত কাম অইত না। আর এই শীতের মিডাম রউদে তেজ নাই।
—তেজ নাই। তয় বড় হুকনা রউদ। দ্যাই না, চউখ-মোখ টানতে শুরু করছে। কাসুর হাত থেকে ধানগাছের নলটা নিয়ে লেদু বলে—দে, বানাইয়া দেই। বাশী তৈরী করতে করতে লেদু বলে—মাইয়ার বিয়াতে গেলা না যে চাচা? তোমার পরাণ কি দিয়া বানাইছে খোদায়? পাথর না পোড়া মাড়ি দিয়া কও দেহি? মায়া-দয়া কি এক্কেরেই নাই তোমার পরাণে? কাসুর মা–
করিম বশের ভ্রূকুটি ক্ষণেকের জন্য লেদুর মুখ বন্ধ করে রাখে। সে কাসুর দিকে বাঁশীটা ছুঁড়ে দিয়ে আবার শুরু করে—তুমি অমুন কর ক্যাঁ, চাচা? কাসু বড় অইয়্যা ওর মা-রে বিচরাইয়া–
করিম বক্শ সাজানো কল্কেটা হুঁকোর মাথায় না বসিয়ে ছুড়ে মারে লেদুর দিকে, চচিয়ে ওঠে—চুপ কর শয়তানের বাচ্চা! মশকারির জাগা পাস না? মানুষ চিনস না তুই?
লেদু ঘাড় নিচু করে আত্মরক্ষা করে। তার মাথার ওপর দিয়ে শো করে কল্কেটা ধানগাছের ঝোপের মধ্যে গিয়ে পড়ে।
আশেপাশের জমি থেকে কুষাণরা ছুটে আসে—কি অইল? কি অইল?
লেদুই বলে–কিছুই না। যাও তোমরা।
লেদু কল্কেটা তুলে গামছা দিয়ে মুছতে মুছতে বলে—রাগ করলা নি, চাচা? আর কোনোদিন কিছু কইমু না। এই কান ডলা খাইলাম দশবার।
করিম বক্শ তখনও রাগে গর গর করছে।
লেদু নিজেই এবার তামাক সেজে হুঁকোটা করিম বকশের হাতে দেয়। তারপর বলে—তোমার জমিনে এইবার ধানে বরাদ্দ নাই। আমাগ লগে ধান কাটতে যাইবা? খুরশীদ মোল্লার বটতলার ক্ষেতে ধান মন্দ অয় নাই। দিবও ছয় ভাগা।
করিম বকশের রাগ থামে। তার বদমেজাজের জন্য কেউ তাকে দলে নিতে চায় না। লেদুর এ প্রস্তাবে সে খুশী হয়। বলে—কবে যাইবা তোমরা?
—এই জমিনের ধান কাডা অইলে। তুমিও তোমার জমিনের ধান কাইট্যা কাবার কর।
–কাবার আমার কাইল অইব। পাতলা পাতলা ধান কাটতে দেরী লাগে না। এইবার তিন মাসের খোরাকীও অইব না। গেল বছর ছয় মাসের ধান পাইছিলাম। এহন তোমরা যদি দলে নেও, তয়ই না বাঁচতে পারমু।
—তোমারে দলে নিতে ত আপত্তি নাই! আপত্তি কিয়ের লেইগ্যা জানো? তোমার মেজাজের লেইগ্যা দলের কেউ রাজী হয় না। যাউকগ্যা, আমি বেবাকেরে বুঝাইয়া ঠিক কইর্যা নিমু। তুমি তোমার মেজাজ খান ঠাণ্ডা কর। আর একটু অইলে আইজ আমার। মাথাডা ফাড়াইয়া দিছিলা আর কি!
করিম বকশের নিজের জমির ধান কাটা শেষ হয়েছে। খুরশীদ মোল্লার বটতলার খেতে ধান কাটতে যাবে সে। কিন্তু কাসুকে আর পেছনে টানতে ভাল লাগে না। বটতলার খেত অনেক দূরে। রোদের মধ্যে এত দূরে নিয়ে ছেলেটাকে বসিয়ে কষ্ট দেয়া তার ইচ্ছে নয়। এ কয় দিনে ছেলেটা শুকিয়ে গেছে। তার চোখ-মুখের দিকে তাকালে মায়া হয়। আর যে ভয়ে সে কাসুকে সাথে সাথে নিয়ে বেড়ায়, সে ভয় সব জায়গায়ই দেখা দিয়েছে। কাসূকে ওর ফুফুর বাড়ী থেকে নিয়ে আসার পর যতগুলো ঘটনা ঘটেছে তাতে কাসু হয়তো অনেক কিছুই বুঝতে পেরেছে। তবুও সে সাধ্যমত চেষ্টা করে। বাজার থেকে বিস্কুট, জিলিপি, কদমা, এনে কাসুকে খেতে দেয়। নিত্য-নতুন খেলনা দিয়ে তাকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করে। কোনো লোককে ওর কাছে ঘেঁষতে দেয় না, পাছে কেউ ওর মা-র কথা বলে দেয়।
কাল পান্তা ভাত খেয়েই করিম বক্শ ধান কাটতে যাবে। কিন্তু কাসকে বাড়ীতে রেখে যেতে তার মন সরে না। আবার তাকে সাথে নিয়ে গিয়েও কোন লাভ নেই। সেখানে উস্কানি দেয়ার লোক আছে যথেষ্ট। জয়গুনের বাড়ীর কাছের কেরামত আছে লেদুর দলে। কে কখন কোন তাল দিয়ে বসে বলা যায় না। সে ভাবে–তাল দিতে পারে সব্বাই,মিডাই দিতে পারে না কেউ।
মহাসমস্যা করিম বকশের সামনে। চিন্তা করে সে কোন সমাধান খুঁজে পায় না। আমন তামাক দিয়ে যায়। তামাক টানতে টানতে সে চিন্তা করে। তার চিন্তা তামাকের ধোয়ার সাথে কুণ্ডলি পাকাতে আরম্ভ করে।
এক সময়ে হুঁকোয় টান দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যায় করিম বক্শ। তারপরই তার চোখে-মুখে হাসি ফুটে ওঠে।
হুঁকোটা বেড়ার সাথে ঠেকিয়ে রেখে সে এক লাফে বেরিয়ে পড়ে। পাশের বাড়ীর হারুনকে ডেকে চুপি চুপি যুক্তি করে দু’জনে।
হারুন বলে—সাদা চুল পাইমু কই?
—আমি যোগাড় কইরা দিমু। তুই এট্টা সাদা কাপড় যোগাড় করিস। আর খবরদার, কেও যেন না জানে। তুই আর আমি, বুঝালি কথা? তিন কান অইলেই সর্বনাশ।