জয়গুনকে ‘বেয়ান’ আর হাসুকে ‘জামাই’ বলতে শুরু করেছিল সে। প্রথম থেকেই লোকটার কথাবার্তা, ভাবগতিক জয়গুনের কাছে সুবিধের মনে হয়নি। সামান্য একটা পেতলের কলসীর জন্যে এত ঘন ঘন কেন সে আসে? ‘বেয়ান’ বলে এত ঘনিষ্ঠতাই বা করতে চায় কেন? কি মতলব?
জয়গুনের মনে সন্দেহ। কিন্তু কিছু বলার উপায় ছিল না। যে লোকটা এত উপকার করল, তাকে কটু কথা বলতেও বাধে।
জয়গুন একটা আস্ত পানে সুপারী, চুন ও খয়ের দিয়ে এগিয়ে দিত। ফকির বলত, বেয়াইরে খিলি বানাইয়া দিলে বুঝিন জাইত যায়, না? কত দিন খোশামুদ কইর্যাও তোমার আতের এক খিলি পান খাইতে পারলাম না। মইরা গেলেও হায়-আফসোস থাকব।
জয়গুন কোন উত্তর দিত না।
পান খেতে খেতে ফকির নানা রকমের কথা বলতে শুরু করত। কখনো কোনো প্রশ্ন করে উত্তরের জন্য হা করে থাকত। উত্তর না পেয়ে আবার শুরু করত। মাঝে মাঝে নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে উঠত লাগামছাড়া হাসি। জয়গুন এ অস্বস্তিকর হাসি-ঠাট্টায় জ্বলে উঠত মনে মনে। পিছ-দুয়ার দিয়ে এক সময়ে সরে পড়ত।
একদিন রাত্রে বৃষ্টি মাথায় করে কোথা হতে ফকির এসে হাজির। জয়গান পান খেতে বসেছিল। ফকিরের আগমনে সে একটু সচকিত হয়ে ওঠে। ছেলেমেয়ে দুটি ঘুমিয়ে পড়েছে। শফির মা-ও বাড়ী নেই আজ।
ফকির দরজার ওপর বসে পান চিবোতে চিবোতে এক সময়ে বলে—বেয়ানের আতের পান খাইতে কি মুলাম! এক্কেরে মুখের সাথে মিশা যায়। যেই আতের পান এত মুলাম, হেই আতখানও না জানি কেমুন। শরীলখানও বুঝিন তুলতুল করে তুলার মতন।
ফকির হাসে। জয়গুনের সমস্ত শরীর কাটা দিয়ে ওঠে। শক্ত একটা কিছু বলতে চায়। কিন্তু মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না।
—দেহি না, বেয়ান! বলতে বলতে সে এগোয়—দেহি না তোমার নরম আতহানে কি লেহা আছে।
জয়গুন পিছিয়ে যায়। বেড়ার সাথে গিয়ে ঠেকে।
—দেহি না আতহান। নওল মুরগীর মতন পলাও ক্যান! ছিঃ ছিঃ!
ফকির হাত বাড়াতেই জয়গুন হাতের কাছের চুনের ঘট্টা ছুঁড়ে দেয় ফকিরের মুখের ওপর। চেঁচিয়ে ওঠে—কুত্তার পয়দা! বাইর অ, বাইর অ ঘরতন।
এ ব্যাপারের পর জোবেদ আলী ফকির আর তার চুন-কালির মুখ সূর্য-দীঘল বাড়ীতে দেখায়নি।….
জয়গুন শফির মার কথার উত্তর দেয়—বেজার অইলে অউক গিয়া। দিমু না কলসী, কাম নাই আর পাহারাদারের।
শফির মা জয়গুনের ভাবান্তরের কারণ খুঁজে পায় না। জয়গুন এমন অকৃতজ্ঞ হল কেমন করে? আর পাহারাদার ছাড়া সূর্য-দীঘল বাড়ীতে থাকবার সাহসই বা তার কোত্থেকে হল?
০২. পাশাপাশি পিঁড়ে বিছিয়ে বসে দুটি ভাইবোন
পাশাপাশি পিঁড়ে বিছিয়ে বসে দুটি ভাইবোন—হাসু ও মায়মুন। জয়গুন পান্তা বেড়ে ছেলে ও মেয়ের সামনে দুটো থালা এগিয়ে দিয়ে নিজেও একটা নিয়ে বসে। মায়মুন আড়চোখে হাসুর থালার দিকে চায়। রোজ সে এমনি চেয়ে দেখে। রোজই হাসুকে বেশী করে খেতে দেয় মা। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস তার হয় না। জয়গুন বুঝতে পেরে নিজের পাতের একমুঠো ভাত দিয়ে বলে—বিছমিল্লা বুইল্যা মোখে দে। দেখবি এই দুগগায়ই প্যাট ভইরা যাইব।
—বিছমিল্লা।
হাসুও বলে—বিছমিল্লা।
প্যাচপেচে পান্তাভাত পোড়া মরিচ মেখে কালো করে নেয়। খেতে খেতে জয়গুন সারাদিনের কাজের ফরমাস করে যায় মায়মুনকে। ঘর ঝাট দেয়া, থালাবাসন মাজা, পানি আনা ইত্যাদি।
—ভাত আছে আর, মা? হাসু বলে।
ভাতের হাঁড়িটা হাসুর থালার ওপর উপুড় করে ঢেলে জয়গুন বলে—খাইয়া নে, পরাণ ঠাণ্ডা অইব।
শুধু পানিতে থালা ভরে যায়। মায়মুনের পাতে তার আবাটা ঢেলে দিয়ে লবণ দিয়ে। ঘেঁটে চুমুক দেয় হাসু।
খাওয়ার পরে জয়গুন পানের ডিবা নিয়ে বসে। পেট ভরে দুটি ভাত খেতে না পেলেও পানটা একটু মুখে দিলে তবু ভালো লাগে।
হাসু কোষার পানি সেচে ডাকে—মা, শিগগির। গাড়ী কইলাম আইয়া পড়ল বইল্যা।
জয়গুন বাশের চোঙা থেকে পঁচটা টাকা বের করে নেয়। এই টাকা কটিই তার মুলধন। ময়মনসিং থেকে সন্তায় চাল এনে সে গায়ে বিক্রি করে। এই করে টাকা প্রতি এক সের সোয়া সের মুনাফা হয় প্রতি খেপে। আচঁলে সব ক’টি টাকা বেঁধে চটের দুটো ঝুলি হাতে বেরিয়ে পড়ে সে তারপর।
দশ বছরের মেয়ে মায়মুন। কিন্তু সাত বছরের বেশী বলে মনে হয় না। হাঁটতে গেলে পাক খেয়ে পড়ে যাবে মনে হয়। একা একা কাজ করতে ভালো লাগে না ওর। কিন্তু কাজের কোনোটা বাকী রাখলে চুল এক গাছও মাথায় থাকবে না, সে জানে। শীর্ণ শরীরটাকে টেনেটুনে কোনো রকমে মাজা-ঘসা করে, বদনা ভরে ভরে সাত আটবারে পানির কলসীটা ভরে সে।
আজ হাঁস দুটো ছাড়তে গিয়ে খাঁচার নিচে ডিম দেখে মায়মুনের আনন্দ আর ধরে না। তাদের হাঁস ডিম দিয়েছে আজ নতুন। কি সাদা আর বড় বড়! দুহাতে দুটো ডিম নিয়ে সে নাচতে আরম্ভ করে। লাফাতে লাফাতে সে বাইরে আসে। দৌড়ে যায় শফির মা-র ঘরে। ডাকে—মামানি গো, অ-মামানি, দাহ কি সোন্দর আণ্ডা। আমাগ আঁসে পাড়ছে। উল্লাস যেন সে ধরে রাখতে পারে না।
—দেহি দেহি বলে মামী হাত পেতে ডিম দুটো নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। তারপর হেসে বলে—ভালো আণ্ডা অইত। পয়লা বারের অইলেও ডাঙর-ডোঙর অইছে! আষ্ট পয়সা কইর্যা বেচতে পারবি এক একটা।
—না গো মামানি, এই আণ্ডা বেচ্তাম না।
—খাবি?
—ওহোঁ। বাচ্চা ফুডাইমু।
—বেইশ, বেইশ! মামী উৎসাহ দিয়ে বলে।
ডিম দুটো তুষের হাঁড়ির মধ্যে রেখে মায়মুন বাড়ীর এদিক ওদিক খুঁজে গাছের শুকনো ডাল ভাঙে। আজ তার কাজ করতে খারাপ লাগে না। আর দিনের চেয়ে অনেক বেশী লাকড়ি যোগাড় করে ফেলল সে।