মায়মুনের কথায় কান না দিয়ে শফি বলে—আইজ ব্যাডাগুলা বাড়ীতে নাই, থাকলে আমাগ গলাই কাইট্যা ফেলাইত রে!
কাছে এলে হাঁস দুটোকে কোষায় তুলে নিয়ে হাত বুলিয়ে আদর করতে থাকে মায়মুন।
শফি কোষ বেয়ে বাড়ী যায়।
নিছক মশার কামড় ছাড়া আর কিছুই ছিল না হাসুর মুখে! দুদিন বাদেই রমজানের ব্যবস্থা মত সে কাজে লেগে যায়।
বিরাট জায়গা নিয়ে দালান উঠছে। হাসুর আনন্দ হয়। কারণ, অনেকদিন এখানে কাজ করা যাবে। এখানে কাজ বেশী। ইট ভেঙে সুরকি করা, ইটের বোঝা টানা, পানি তোলা—এইসব কাজ করতে হয়। ভোর থেকে বিকেল পর্যন্ত খাটতে হয়। এক মুহূর্তও বসে কাটাবার উপায় নেই। কিন্তু তবুও হাসুর খারাপ লাগে না। স্টেশনে টো-টো করে ঘোরার চেয়ে এ কাজ অনেক ভালো। এখানে ইচ্ছে মতো বোঝা নেওয়া যায়। কেউ ভারী বোঝা মাথায় চাপিয়ে দেয় না। কিন্তু স্টেশনের যাত্রী বাবু-সাহেবরা মাঝে মাঝে এত ভারী বোঝা মাথায় চাপিয়ে দেয় যে ঘাড় ভেঙ্গে যাবার উপক্রম হয়। স্টেশনে কাজেরও কোন ঠিকানা নেই, পয়সারও কোন ঠিক নেই।
বারো আনা পয়সা প্রায় দিনই হয়ে ওঠে না। কিন্তু এখানে একদিন কাজ করলেই বাধা। এক টাকা। এক পয়সাও কম না। বন্ধুত্বের খাতিরে এক আনা করে সরদারি দিতে হয় না। রমজানকে! স্টেশনের কাজে আরও কত ঝকমারি। বাবুদের সাথে দরাদরি, ভিড় ঠেলে পথ চলা, সাঁতার কেটে স্টীমারে ওঠা, এইসব। এগুলো সহ্য হলেও নম্বরী কুলিদের অত্যাচার একেবারেই অসহ্য।
হাসুদের দলের সব ছেলেই এখানে কাজে যোগ দিয়েছে। হাস শফিকে এনে এখানে কাজে ভর্তি করে দেয়।
শফি একদিন মা-কে বলে—মা, তুমি আর খরাত কইর্য না। মাইনষে মন্দ ক০০
ছেলের মুখের কথা লুফে নিয়ে মাথা নেড়ে শফির মা বলে—মাইনষে কয় খরাতনীর পুত? হেইয়াতে কি গায়ে ঠোয়া পড়ে? দশ-দুয়ার মাইগ্যা আইন্যা তোরে এতখানি ডাঙ্গর করছি।
জয়গুন বলে—পোলা তোমার উচিত কতাই কয় গো। ও অহন যাইডের বড় অইছে। রোজগারও করছে। ওর শরম লাগনের কতাই।
—ও রুজি-রোজগার করলে আর আমার ভাবনা কি! আমি খরাত করি কি আমার আমোদে? ঠ্যাঙ্গের জোরও গেছে। শরীলেও তাকত নাই। অহন সারাদিন এক ও’কত খাইয়া আর বইস্যা খোদার শুকুর ভেজতে পারলে বাঁচি।
১২. গন্ধভাদাল পাতা
বিকেল বেলা ঘুরে ঘুরে জয়গুন অনেক গন্ধভাদাল পাতা যোগাড় করে আনে। শহরের গিন্নিরা এ জংলী শাকের বড়া খেতে ভালবাসে। পাতাগুলো শুকিয়ে ওঠে বলে রাত্রিবেলা ওগুলো সাজিয়ে ঘরের চালার ওপরে রেখে দেয়া হয়।
রাত্রির শিশির-ভেজা হয়ে ভোর বেলায় পাতাগুলো সতেজ ও সজীব হয়ে ওঠে। রোদ উঠবার আগে জয়গুন চালার ওপর থেকে চাঙারিটা নামিয়ে নেয়। তারপর বসে বসে চার পয়সায় কতটা, তা আলাদা করে সে চাঙারির ভেতর সাজিয়ে নেয়।
খাওয়া সেরে জয়গুন তুষের হাঁড়ির থেকে আটটা ডিম নিয়ে গন্ধভাদাল পাতার মাকে বসিয়ে দেয়। তারপর চাঙ্গারিটা কাঁধে নিয়ে হাসু ও শফির সাথে কোষায় এসে বসে।
সবুজ মাঠের মাঝ দিয়ে কোষা চলে। ধান খেতের দিকে চেয়ে জয়গুনের চোখ জুড়ায়। নতুন শীয় মাথা বের করেছে। শীষের ভাবে ঈষৎ নুয়ে পড়েছে ধানগাছগুলো। মাঝে মাঝে ঝিরঝিরে বাতাস এসে সবুজ খেতে ঢেউ খেলিয়ে দিয়ে যায়।
জয়গুন বলে—-এই বচ্ছর খোদায় দিলে পান অইব খুব। আর না খাইয়া মরতাম না। এই সময় বিষ্টি রইয়া-সইয়া আইলে অয়। শীষমোখে বিষ্টি পাইলে বরবাদ অইয়া। যাইব।
হাসু বলে—কেমন মোটা মোট্টা ছড়া বাইর অইছে, দ্যাহ মা। বেবাক জায়গায় এইবার ভালা ধান অইব। উজান দেশেও হুনছি খুব বরাদ্দ দ্যাহা যায়।
—অউক। বরাদ্দ অইলেই খাইয়া বাঁচতে পারমু। এইবার পরা ফসল না অইলেও, বারো আনা ফসল অইব, অহন যেই রহম ভাওবরাদ্দ দাহা যায়। গেল বছর আধা ফসলও অয় নাই।
শফির হাতে লগি। সে একটা ধানখেতের ভেতর কোষা চালাতেই জয়গুন বাধা দেয়—এই কি করস, শফি? এমন ভরা খেতের মইদ্যে দিয়া নাও বাইতে আছে?
—ক্যান? এইডা তো আর আমাগ খেত না।
-অলক্ষ্মী ছেঁড়ার কথা হোন। আমাগ খেত নাই বুইল্যা তুই অমন ফুলে ভরা ধানের উপর দিয়া কোষা চালাবি? যা খাইয়া মানুষ বাঁচে, হেইয়া লইয়া খেলা! খেতের আইল। দিয়া যা।
——আইল দিয়া গেলে, কিন্তুক দেরী অইব।
—অউক দেরী। ধানের ছড়া বাইর অইছে। খেতের মাঝ দিয়া আর যাওন যাইব না। এট্ট টোক্কা লাগলেই কাইত অইয়া পড়ব, আর মাথা খাড়া করতে পারবো না।
শফি খেতের আল ধরে কোষা চালায়।
যে খেতে পাট ছিল সেগুলো কচুরিপানায় ছেয়ে গেছে। চার পাশের ধানখেতগুলোরও অনেকটা জায়গা গ্রাস করেছে কচুরীপানায়। কচুরির ঝাড়ে বিচিত্র ফুলের মেলা।
দু’একজন নিরলস কৃষক খেতের চারপাশে বাঁশের বেড়া দিয়ে কচুরিপানার আক্রমণ ঠেকিয়েছে।
দু’একটা জলা-খেতে যেখানে কচুরিপানার উৎপাত নেই, সেখানে আধবোজা শাপলার ল। রোদের তেজ বাড়লে বুজে যাবে।
যেতে যেতে জয়গুন বলে কয়েকটা শাপলা তুইল্যা লইয়া যাই। উকিল বাবুর বউ। হেদিন কইয়া দিছিল।
শাপলা তুলে গোটা কয়েক তাড়া বেঁধে নেয় জয়গুন।
একটা ট্রেন সবেমাত্র যাচ্ছে স্টেশন থেকে। হাসু ও শফি দৌড়ে গিয়ে চলতি গাড়ীর হাতল ধরে লাফিয়ে ওঠে পাদানের ওপর। হাসু চেঁচিয়ে বলে—তুমি ধীরে-হস্তে আহ মা। আমরা গেলাম।
জয়গুন শাপলার তাড়া কয়টা কুনইর সাথে ঝুলিয়ে, চাঙারি কাঁধে নারায়ণগঞ্জের দিকে যায়।
মসজিদের মৌলবী সাহেব আসছেন। তার মুখোমুখি হওয়ায় সঙ্কুচিত হয় জয়গুন। তার হাত দু’খানাই আটকা থাকায় সে মাথার কাপড়টাও টেনে দিতে পারে না। পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে যায় সে। আড়চোখে চেয়ে মৌলবী সাহেব অস্পষ্ট স্বরে বলে ওঠেন—তওবা তওবা!